

বৃহস্পতিবার ● ৮ মে ২০২৫
প্রথম পাতা » স্বাস্থ্য » সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে, বেসরকারিতে সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা
সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে, বেসরকারিতে সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা
বজ্রকণ্ঠ ডেস্ক::
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় শতভাগ সরকারি অর্থায়ন অর্থাৎ বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন। এছাড়া সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি পর্যায়ের চিকিৎসাসেবায় হাইব্রিড অর্থায়ন মডেল চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। যেন সাধারণ মানুষ সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নত চিকিৎসাসেবা পেতে পারে।
হাইব্রিড অর্থায়ন মডেল চালু হলে সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি সেবায় সমতা, সক্ষমতা ও আর্থিক সুরক্ষা বৃদ্ধি পাবে। সম্প্রতি স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এমন সুপারিশ করা হয়।
গত বছরের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন, স্বাস্থ্য, নারীবিষয়ক সংস্কারে বিভিন্ন নামে কমিশন গঠন করে সরকার।
২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর জাতীয় অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। গত ৫ মে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়। কমিশনের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করা হয়।
স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে একটি ন্যায্য, প্রতিক্রিয়াশীল ও আর্থিকভাবে সুরক্ষিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে শতভাগ সরকারি অর্থায়নের মাধ্যমে সর্বজনীন ও বিনামূল্যে নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে একটি করভিত্তিক অর্থায়ন কাঠামো গ্রহণ করা প্রয়োজন, যেখানে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, টিকাদান, সাধারণ রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা রাজস্ব থেকে অর্থায়িত হবে। মূলত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হবে।
এই মডেল চালু হলে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যয় কমবে। পাশাপাশি নাগরিকরা আয়, অঞ্চল বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রয়োজনীয় সেবার ন্যায্য অধিকার লাভ করবে।
স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক এ কে আজাদ খান বলেন, এ মডেল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সফলভাবে কার্যকর হয়েছে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসেস প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় শতভাগ করভিত্তিক অর্থায়নের মাধ্যমে সর্বজনীন প্রবেশাধিকার ও আর্থিক সুরক্ষার একটি বিশ্বমানের উদাহরণ। থাইল্যান্ডে ইউনিভার্সাল কাভারেজ স্কিম এবং শ্রীলঙ্কায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাও দেখিয়েছে- যখন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সর্বজনীন ও বিনামূল্যে প্রদান করা হয়, তখন স্বাস্থ্যগত বৈষম্য কমে। এতে জনগণের স্বাস্থ্য সূচক উন্নত হয় এবং আউট অব পকেট (নিজ খরচ) ব্যয়ের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য কমে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে এই মডেল চালু হলে এটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনস্বাস্থ্যের প্রতি একটি স্পষ্ট ও সাহসী প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখা যাবে। এতে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা বাড়বে, স্বাস্থ্যখাতে জনআস্থা জোরদার হবে এবং সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার (ইউএইচসি) ভিত্তি আরও মজবুত হবে। এটি হবে একটি নীতিগত মাইলফলক, যা ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিবর্তনের পথ তৈরি করবে।
স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার প্রতিবেদনে সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি সেবায় সমতা, সক্ষমতা ও আর্থিক সুরক্ষা বাড়াতে প্রাথমিক সেবার বাইরে একটি হাইব্রিড অর্থায়ন মডেল চালুর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই মডেলে অগ্রাধিকারভিত্তিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেবা- যেমন মাতৃত্বকালীন সেবা, জরুরি অস্ত্রোপচার এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগ ব্যবস্থাপনা সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনামূল্যে দেওয়া হবে। পাশাপাশি, এসব সেবা সবার জন্য সহজলভ্য করতে সরকার মূল্যনিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির মাধ্যমে বেসরকারি খাত থেকেও সেবা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করবে। এই মিশ্র ব্যবস্থা জনগণের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, সেবায় সমতা বজায় রাখবে এবং পুরো ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিত করবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এ ধরনের হাইব্রিড মডেল স্বাস্থ্যসেবার ভারসাম্য রক্ষা এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সেবায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে কার্যকর। থাইল্যান্ডে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে। সেখানে উচ্চ ও মধ্যম খরচে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেওয়া যায়, যা একই নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়। এতে সেবা বিভাজন কমে এবং কার্যকারিতা বাড়ে। কলম্বিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি সেবা প্রদান একই নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়। এসব মডেল দেখায় একটি সুসংহত হাইব্রিড ব্যবস্থা স্বাস্থ্য খাতকে আরও টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলে।
বাংলাদেশে এই মডেল চালু হলে প্রাথমিক ও জটিল সেবা- উভয় ক্ষেত্রে প্রবাসীদেরও আর্থিক সুরক্ষা বাড়বে। এটি মধ্যম আয়ের জনগণের জন্য একটি সাশ্রয়ী বিকল্প তৈরি করবে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় সেবা দেবে। একই সঙ্গে সরকারি হাসপাতালের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ কমাবে। এর ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও প্রতিক্রিয়াশীল, ব্যয় সাশ্রয়ী ও ন্যায্য হয়ে উঠবে।
বাধ্যতামূলক সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা চালুর সুপারিশ
স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে দেশে বাধ্যতামূলক সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিমার মাধ্যমে ক্যানসার, কিডনি বিকল, জটিল অস্ত্রোপচার ও অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগে আর্থিক সুরক্ষা দেবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি পেশাজীবীদের বাধ্যতামূলক এই বিমায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তা ও কর্মচারীর যৌথ প্রিমিয়ামের ভিত্তিতে বিমা পরিচালনার সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে এই বিমার আওতায় আনতে সরকারি ভর্তুকির সুপারিশ করেছে কমিশন। পরবর্তী পর্যায়ে টার্গেটেড ভর্তুকির আংশিক অর্থ প্রদানের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের এ বিমায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভিয়েতনাম বাধ্যতামূলক প্রিমিয়াম, ভর্তুকি ও বহুমাত্রিক তহবিল একীভূত করে সোশ্যাল হেলথ ইন্স্যুরেন্স কার্যকর করেছে। রুয়ান্ডা প্রাতিষ্ঠানিক খাতে সোশ্যাল হেলথ ইন্স্যুরেন্স চালুর পাশাপাশি কমিউনিটি ভিত্তিক বিমার মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক খাতকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এসব অভিজ্ঞতা দেখায়, সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা ধাপে ধাপে চালু করা সম্ভব, এমনকি স্বল্প সম্পদের দেশেও।
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সোশ্যাল হেলথ ইন্স্যুরেন্স চালুর মাধ্যমে উচ্চ ব্যয়ের চিকিৎসা সেবায় প্রবেশাধিকার বাড়বে। এতে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয়জনিত দারিদ্র হ্রাস পাবে এবং স্বাস্থ্য খাতে পূর্বানুমেয়, সমন্বিত ও স্থিতিশীল অর্থায়নের ভিত্তি তৈরি হবে। এটি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের পথ আরও শক্তিশালী ও টেকসই করে তুলবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিষয়: #বিনামূল্যে #বেসরকারিতে #সরকারি #সাশ্রয়ী #স্বাস্থ্যসেবা #হাসপাতালে
