

রবিবার ● ১০ আগস্ট ২০২৫
প্রথম পাতা » বিশেষ » ছাত্র রাজনীতি: নেতৃত্বের হাতেখড়ি নাকি দাসত্বের লেজুড়বৃত্তি?
ছাত্র রাজনীতি: নেতৃত্বের হাতেখড়ি নাকি দাসত্বের লেজুড়বৃত্তি?
ড. মাহরুফ চৌধুরী
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা অঙ্গন বহু দশক ধরেই দলীয় রাজনীতির গভীর প্রভাবের মধ্যে অবস্থান করছে, যা একদিকে এক গৌরবময় ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের ধারক, কিন্তু অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী সংকটের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে ছাত্র রাজনীতি ছিল মুক্তিকামী চেতনার প্রাণপ্রবাহ। এটি কেবল শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করার মাধ্যমই ছিল না, বরং গণতন্ত্র রক্ষা, শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব- প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। বিশেষত ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ছাত্র নেতৃত্ব প্রমাণ করেছে যে উচ্চশিক্ষা স্তরে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি কেবল ব্যক্তিগত উন্নতির পথ নয়, বরং জাতির মুক্তি ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানে যাকে ‘রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ’ (পলিটিক্যাল সোসালাইজেশন ) বলা হয়ে থাকে, অর্থাৎ শিক্ষা গ্রহণকালে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্বের বীজ বপন করা, তার বাস্তব উদাহরণ ছিল সে সময়ের ছাত্র রাজনীতি। এটি ছিল এক ধরনের নাগরিক চেতনার উন্মেষ ও বিকাশের পাঠশালা, যেখানে শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠত। জন ডিউইয়ের গণতান্ত্রিক শিক্ষাদর্শে যেমন বলা হয়েছে, শিক্ষা কেবল পাঠ্যপুস্তকের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি সামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ডিউই বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্র কেবল রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে সীমিত নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনের একটি সক্রিয় অনুশীলন, যেখানে শিক্ষা হয়ে ওঠে নাগরিক অংশগ্রহণের প্রস্তুতিমূলক ক্ষেত্র। সেই প্রেক্ষাপটে, মুক্তিকামী ছাত্র রাজনীতি ছিল ডিউইয়ান আদর্শের বাস্তব প্রয়োগ যেখানে শিক্ষার্থীরা কেবল জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়নি, বরং দায়িত্ব, ত্যাগ ও নেতৃত্বের গুণাবলিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
যাই হোক, ইতিহাসের এই গৌরবময় অধ্যায়ের পর সময়ের প্রবাহে ছাত্র রাজনীতির চরিত্র ও উদ্দেশ্যে দ্রুত ও সুস্পষ্ট পরিবর্তন দেখা দেয়। যেখানে একসময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছিল মুক্তচিন্তার বিকাশ, মতাদর্শ বিনিময় ও সামাজিক পরিবর্তনের পরীক্ষাগার, সেখানে ধীরে ধীরে তা পরিণত হয় দলীয় স্বার্থ রক্ষার এক সংঘর্ষময় রণক্ষেত্রে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র সংগঠনকে তাদের সাংগঠনিক ‘নার্সারি’ ও ‘পেশীশক্তির উৎস’ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে, ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি গড়ে ওঠার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ভেঙে গিয়ে তা হয়ে ওঠে দলীয় আনুগত্যের প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষা ক্ষেত্র। এভাবে, অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আদর্শবাদী সংগ্রামের পরিবর্তে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের প্রতি অন্ধ আনুগত্যে আবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাদের সেবাদাসে পরিণত হয়।
ইটালীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিওভান্নি সার্টোরি (১৯২৪-২০১৭) ‘লেজুড়বৃত্তি’ (ক্লাইয়েন্টেলিজম)-কে ক্ষমতার কাঠামোয় এক ক্ষতিকর সম্পর্ক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে অনুসারীরা ব্যক্তিগত বা স্বল্পমেয়াদি সুবিধা- যেমন আবাসন, আর্থিক সহায়তা, বা রাজনৈতিক প্রভাবের সুযোগ- পাওয়ার বিনিময়ে নেতাদের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন করে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই লেজুড়বৃত্তি গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে পড়েছে, যার ফলে ছাত্র রাজনীতি ধীরে ধীরে নীতি ও আদর্শ হারিয়ে ‘দলীয় সুবিধাভোগে’র চক্রে বন্দি হয়ে গেছে। রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানীরা একে ‘পৃষ্ঠপোষক- উপকারগ্রহীতা’ (প্যাট্রোন-ক্লায়েন্ট) মডেলের একটি বিকৃত রূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, যেখানে নেতারা ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং অনুসারীরা স্বার্থ হাসিল করতে পারস্পরিক নির্ভরতার এক অদৃশ্য চুক্তিতে আবদ্ধ থাকে। এর ফলশ্রুতিতে শিক্ষাঙ্গনে সৃষ্টিশীলতা, ভিন্নমত সহনশীলতা এবং সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার জায়গা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, ছাত্র রাজনীতির অবক্ষয়ের এই ধারা কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আফ্রিকার কয়েকটি দেশ, যেমন কেনিয়া ও উগান্ডায় তাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যক্ষ প্রভাবের মুখে পড়েছে। সেখানে ছাত্র সংগঠনগুলো অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয় রাজনৈতিক দলের উপশাখায় পরিণত হয়েছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে ভবিষ্যৎ দলীয় কর্মী ও প্রচারক তৈরি করা। দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল ও শ্রীলঙ্কাতেও একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যেখানে ছাত্র রাজনীতি প্রায়শই শিক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক সংঘাত ও দলীয় স্বার্থ রক্ষার দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে। এর ফলে শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা, সেশনজট এবং একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার মতো সমস্যা তৈরি হয়। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় এখনও ছাত্র রাজনীতিকে একধরনের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশিক্ষণক্ষেত্র’ হিসেবে ধরে রেখেছে। সেখানে রাজনৈতিক সক্রিয়তা মূলত বিতর্ক, মতবিনিময় এবং নীতি প্রস্তাব তৈরির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আদর্শগত পার্থক্য বজায় রেখেও জনসম্মুখ বক্তৃতা, একাডেমিক সেমিনার ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে। সহিংসতার পরিবর্তে মতাদর্শিক যুক্তি, পরিসংখ্যানভিত্তিক তথ্য এবং গবেষণা-নির্ভর আলোচনাই সেখানে প্রাধান্য পায়।
ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক আন্দ্রে বেতেল (১৯৩৪-) মতে, এই ধরনের সংস্কৃতি শিক্ষার্থীদের কেবল রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ায় না, বরং গণতান্ত্রিক আলাপ-আলোচনা ও নীতি-প্রণয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যও প্রস্তুত করে। এ থেকে বোঝা যায়, ছাত্র রাজনীতি অবশ্যম্ভাবীভাবে অবক্ষয়ের দিকে যাবে এমন ধারণা সার্বজনীন নয়; বরং সঠিক সাংগঠনিক কাঠামো ও সংস্কৃতি থাকলে এটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের অন্যতম কার্যকর মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। শিক্ষা ও নেতৃত্ব বিকাশের তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ছাত্র রাজনীতি একদিকে সম্ভাবনার এক উন্মুক্ত ক্ষেত্র, অন্যদিকে তা যদি ভুলপথে পরিচালিত হয় তবে হয়ে উঠতে পারে অবক্ষয়ের সূতিকাগার। ব্রাজিলীয় শিক্ষাবিদ পাউলো ফ্রেইরি (১৯২১-১৯৯৭) ‘নিপীড়িতের শিক্ষা’ (প্যাডাগোজি অব দ্য অপ্রেসড) বইয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল পাঠ্যবস্তুর জ্ঞান স্থানান্তর নয়; বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘সমালোচনামূলক বা বিশ্লেষণী চেতনা’ (ক্রিটিক্যাল কনসিয়াসনেস) গড়ে তোলা, যাতে তারা সামাজিক অন্যায় সনাক্ত করতে পারে এবং তা পরিবর্তনের জন্য সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সুশৃঙ্খল ও নীতি-ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি তরুণদের মধ্যে নেতৃত্ব, সংগঠন পরিচালনা, জনসম্মুখে বক্তৃতা, দল গঠন, দর-কষাকষি তথা সমযোতা এবং সমস্যা সমাধানের মতো বাস্তব জীবনের দক্ষতা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে।
রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানীরা একে ‘নাগরিক শিক্ষা’ (সিভিক লার্নিং) প্রক্রিয়ার সম্প্রসারণ হিসেবে দেখেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন করে না, বরং বাস্তব জীবনের জটিল সমস্যা সমাধানে হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। আন্তর্জাতিক উদাহরণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬০–৭০-এর দশকে ‘নাগরিক অধিকার আন্দোলন’ (সিভিল রাইটস মুভমেন্ট)-এ অংশ নেওয়া বহু শিক্ষার্থী পরবর্তী সময়ে রাজনীতি, আইন, সাংবাদিকতা ও সামাজিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। যেমন, জেসি জ্যাকসন ও জন লুইসের মতো নেতারা ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে যে নেতৃত্বগুণ অর্জন করেছিলেন, তা তাদের আজীবন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়েছে। একইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘দখলদার বিরোধী’ (এন্টি-অ্যাপার্টহাইড) আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলন করেনি, বরং পরবর্তীতে জাতীয় নেতৃত্ব ও নীতি-প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এতে স্পষ্ট হয় যে, ছাত্র রাজনীতি সঠিকভাবে পরিচালিত হলে তা হতে পারে নেতৃত্বের হাতেখড়ি ও সমাজ পরিবর্তনের কার্যকর অনুশীলনক্ষেত্র; কিন্তু নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে তা দ্রুতই ক্ষমতার লড়াই, বিভাজন এবং সহিংসতার দিকে গড়িয়ে পড়তে পারে।
ছাত্র রাজনীতির ইতিবাচক সম্ভাবনা তখনই বাস্তবায়িত হবে যখন সেটা ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীগত প্রতিযোগিতা এবং দলীয় কর্তৃত্বের হাতিয়ার না হয়ে ওঠে। জার্মান বংশোদ্ভুত ইটালীয় সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানী রবার্ট মিশেলস (১৮৭৬-১৯৩৬) তার সুপরিচিত তত্ত্ব ‘অলিগার্কির লৌহ আইন’ (আইরন ল’ অব অলিগার্কি)-এ দেখিয়েছেন যে, যেকোনো সংগঠন যদি ধীরে ধীরে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া হারায়, তবে তা অবশ্যম্ভাবীভাবে কেবল কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক গণতান্ত্রিক উদ্দেশ্যগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং সংগঠন পরিণত হয় একটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক কাঠামোয়, যেখানে শীর্ষ নেতৃত্ব নিজেদের অবস্থান সুসংহত করাকেই প্রধান লক্ষ্য মনে করে। বাংলাদেশের বর্তমান ছাত্র রাজনীতিতে এই তত্ত্বের প্রতিফলন স্পষ্ট। নীতি-আদর্শ ও গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের পরিবর্তে এখানে দখলদারিত্বের রাজনীতি, ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি প্রাধান্য পাচ্ছে। ছাত্র সংগঠনগুলোর অনেক শীর্ষ পদ অলিখিতভাবে দীর্ঘমেয়াদি ব্যক্তিগত ক্ষমতার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে নেতৃত্বের পরিবর্তন বা নতুন নেতৃত্ব গড়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে আবাসন, টেন্ডার, এমনকি ভর্তি প্রক্রিয়ার মতো বিষয়েও দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা একদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক একাডেমিক জীবনকে ব্যাহত করে, অন্যদিকে ভিন্নমত ও স্বাধীন চিন্তার ক্ষেত্র সংকুচিত করে ফেলে।
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানীরা একে ‘পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি’ (প্যাট্রোনেজ পলিটিক্স)-এর সঙ্গে তুলনা করেন, যেখানে ক্ষমতাসীনদের প্রতি আনুগত্যই সংগঠনে টিকে থাকার প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, ছাত্র রাজনীতি আর নেতৃত্বের প্রশিক্ষণক্ষেত্র থাকে না; বরং হয়ে ওঠে ক্ষমতার অনুগামী তৈরি করার কারখানা। এই প্রেক্ষাপটে, মিশেলসের ‘অলিগার্কির লৌহ আইন’ কেবল তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা নয়, বরং বাংলাদেশের সমকালীন ছাত্র রাজনীতির এক জীবন্ত বাস্তব প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। সে যাই হোক, বর্তমানের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির সহিংসতা, দখলদারিত্ব এবং শিক্ষার ক্ষতি নিয়ে বিস্তৃত ও পদ্ধতিগত গবেষণা এখন সময়ের দাবি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের স্নাতক সম্পন্ন করতে গড় সময় ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে, যার অন্যতম কারণ ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহিংসতা, ক্লাস ও পরীক্ষার দীর্ঘসূত্রিতা এবং প্রশাসনিক অচলাবস্থা। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক সংঘর্ষের ফলে একাডেমিক ক্যালেন্ডার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় অনেক শিক্ষার্থীর ডিগ্রি সম্পন্ন হতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দুই থেকে তিন বছর বেশি সময় লাগে।
১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান পর্যন্ত ক্যাম্পাসভিত্তিক রাজনৈতিক সহিংসতায় বহু শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছে, অগণিত শিক্ষার্থী আহত হয়েছে, এবং অনেকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করেছে। বিদ্যমান তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, গত দুই দশকে শতাধিক শিক্ষার্থী রাজনৈতিক সংঘর্ষে নিহত এবং কয়েক হাজার আহত হয়েছে। এ ছাড়া ‘দখলদারিত্ব সংস্কৃতি’ ছাত্র রাজনীতির অন্যতম কুপ্রভাব হিসেবে চিহ্নিত, যেখানে আবাসিক হলগুলো প্রায়শই দলীয় কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আবাসন, লাইব্রেরি, এমনকি ক্যান্টিনের মতো মৌলিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হয়। অপরদিকে সহিংসতা ও অনিশ্চিত একাডেমিক পরিবেশ দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশকে বিদেশমুখী করে তুলছে। এ প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য ‘মেধাপাচার’ (ব্রেইন ড্রেইন) সংকটকে তীব্রতর করছে, যা অর্থনীতি ও সমাজ উভয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং ইউনেস্কোর বিভিন্ন গবেষণা ইঙ্গিত দিয়েছে যে, একটি দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ অপরিহার্য। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা অঙ্গনে বর্তমান পরিস্থিতি সেই মানদণ্ড থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে, যা কেবল একাডেমিক মান ক্ষুণ্ণ করছে না, বরং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনের ক্ষেত্রকেও ধ্বংস করছে।
এই বাস্তবতায় ছাত্র রাজনীতির সংস্কারের জন্য প্রয়োজন সুস্পষ্ট ও কার্যকর নীতিমালার প্রস্তাবনা, যা একদিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক ও নেতৃত্বমূলক সক্ষমতা বিকাশে সহায়ক হবে। নিচে কয়েকটি বিষয় বিবেচনার জন্য তুলে ধরা হলো।
প্রথমত, দলীয় রাজনীতি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক দূরত্ব বজায় রাখা অত্যাবশ্যক, যাতে ছাত্র সংগঠনগুলো জাতীয় রাজনৈতিক দলের উপশাখা না হয়ে কেবল শিক্ষার্থীদের একাডেমিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক স্বার্থে কাজ করে। এ প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এমন নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যা প্রাতিষ্ঠানিক পরিমণ্ডলে সরাসরি দলীয় প্রভাব বিস্তার রোধ করবে।
দ্বিতীয়ত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ছাত্র নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া চালু করা অপরিহার্য, যেখানে সব শিক্ষার্থী সমান ভোটাধিকার ভোগ করবে এবং প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় থাকবে। ভারতের জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও কার্যকর মডেল হতে পারে।
তৃতীয়ত, সহিংসতার বিরুদ্ধে ‘কোনো প্রকার ছাড় না দেওয়া’ (জিরো-টলারেন্স)-এর নীতি কার্যকর করতে হবে। ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে অপরাধীদের প্রশাসনিক ও আইনি শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এই নীতি কেবল ঘোষণামূলক না হয়ে কার্যকর হতে হলে দ্রুত তদন্ত, সুষ্ঠু বিচার এবং ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।
চতুর্থত, ছাত্র রাজনীতিকে দক্ষতা বিকাশের একটি ইতিবাচক প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করার জন্য নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ, জনসম্মুখে বক্তৃতা, বিতর্ক, নীতি প্রস্তাব প্রণয়ন, এবং স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মকাণ্ডের মতো কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত ‘শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশের কার্যক্রম’ (স্টুডেন্ট লিডারশীপ প্রোগ্রাম) শিক্ষার্থীদের সামাজিক নেতৃত্ব ও নাগরিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
পঞ্চমত, আবাসিক হল, ক্যাম্পাস সম্পদ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বণ্টনে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল অ্যাপ্লিকেশনভিত্তিক হল বরাদ্দ ব্যবস্থা এবং ক্যাম্পাস সম্পদের ব্যবহার সংক্রান্ত তথ্য উন্মুক্ত রাখা যেতে পারে, যাতে সকল শিক্ষার্থী সমানভাবে উপকৃত হয় এবং দখলদারিত্ব সংস্কৃতি হ্রাস পায়।
এ ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি আবারও নেতৃত্ব বিকাশ ও সামাজিক অগ্রগতির কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, যেমনটি ছিল এর গৌরবময় অতীতে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস গৌরবমণ্ডিত, বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি জাতীয় সংকটে শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সেসব সময়ে ছাত্র রাজনীতি ছিল জাতির বিবেক ও অগ্রগতির অগ্রদূত, যা আদর্শ, আত্মত্যাগ এবং গণমানুষের মুক্তির স্বপ্নে অনুপ্রাণিত ছিল। কিন্তু ক্রমে তা বহুলাংশে রূপ নিয়েছে দলীয় আনুগত্য, সহিংসতা, দখলদারিত্ব এবং সুযোগসন্ধানী রাজনীতির এক নেতিবাচক সংস্কৃতিতে। এই অবক্ষয় শুধু একাডেমিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গঠনের ক্ষেত্রকেও সংকুচিত করেছে।
ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, সঠিক নীতি, স্বচ্ছ নির্বাচন, সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতি আবারও পরিণত হতে পারে নেতৃত্বের হাতেখড়ির এক প্রাণবন্ত বিদ্যালয়ে। সেখানে তরুণরা শিখবে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার চর্চা যা কেবল ব্যক্তিগত উন্নয়নেই নয়, সমগ্র জাতির অগ্রযাত্রায় অবদান রাখবে। জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে যে প্রশ্নটি আজ সুস্পষ্ট ও অনিবার্য: আমরা কি সাহসী সংস্কার ও সম্মিলিত উদ্যোগের পথে হাঁটব, নাকি পুনরায় গতানুগতিক ছাত্র রাজনীতির পথে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে রাজনৈতিক দাসত্বের অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেব? উত্তর নির্ভর করছে আমাদের দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং শিক্ষার্থীদের নিজস্ব জাগরণের ওপর। ইতিহাসের গৌরব যদি ফিরিয়ে আনতে হয়, তবে এখনই সময় ছাত্র রাজনীতিকে ‘দাসত্বের লেজুড়বৃত্তি’ থেকে মুক্ত করে ‘দেশ ও দশের কল্যাণে’ দ্রুত ‘দায় ও দরদের’ ভিত্তি ছাত্রসমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিকল্পে স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশের উপযোগী নেতৃত্বে রূপান্তরিত করার।
* লিখেছেন: ড. মাহরুফ চৌধুরী, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।
বিষয়: #ছাত্র #দাসত্ব #নাকি #নেতৃত্ব #রাজনীতি #লেজুড়বৃত্তি #হাতেখড়ি