

মঙ্গলবার ● ৮ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » প্রবাসে » বর্তমানে বাংলাদেশে ভয়াবহ সময় পার করছে নারী এবং কন্যা শিশু
বর্তমানে বাংলাদেশে ভয়াবহ সময় পার করছে নারী এবং কন্যা শিশু
” ছান্দসিক আয়োজিত ‘জাগো মানুষ’ শিরোনামে কথা, কবিতা ও গানে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ” -নিলুফা ইয়াসমীন হাসান
মতিয়ার চৌধুরী, লন্ডন:
বাংলাদেশে বর্তমানে ভয়াবহ সংকটে আছে নারী এবং কন্যা শিশু। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এর তথ্য অনুযায়ী গত ছয় মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৫৪টি, দলবদ্ধ ধর্ষণ সংগঠিত হয়েছে ১৩৬টি এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৭জনকে। কেবলমাত্র জুন মাসেই ৫৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে । নারীর প্রতি সহিংসতার এই চরম উদ্বেগজনক পরিস্থিতির তীব্র প্রতিবাদ এবং প্রতিকারের জন্য আবৃত্তি সংগঠন ‘ছান্দসিক’ আয়োজন করেছে ‘জাগো মানুষ’ শিরোনামে আলোচনা, কবিতা ও গান।
৫ই জুলাই শনিবার ভার্চুয়ালী অনুষ্ঠিত নারী নির্যাতনের এই প্রতিবাদের নাম ‘জাগো মানুষ’ কেন নির্ধারণ করা হলো তার ব্যাখা করে ছান্দসিকের কর্ণধার মুনিরা পারভীন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই তিনি কবি, সাহিত্যিক ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের গবেষক অপূর্ব শর্মার লেখা কবিতা ‘জাগো মানুষ, জাগো মানুষ/ শক্তি কর সঞ্চয়/ বেদনার অশ্রু মুছে/ হও তুমি নির্ভয়’ কবিতা আবৃত্তি করেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নারী আন্দোলন নেত্রী সীমা মোসলেম ঢাকা থেকে যোগ দিয়ে তার বক্তব্যে গত ছয় মাসে বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমরা একটা ভয়াবহ সময় পার করছি। গত এক মাসেই ৫৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। নারীর প্রতি নির্যাতনের ধরণ দিন দিন বদলাচ্ছে। তিনি বলেন, যদিও নারী নির্যাতনের সকল সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়না, তারপরও সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ যে তালিকা প্রকাশ করেছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। সীমা মোসলেম বলেন, যেটা বর্তমানে চরম রূপ ধারণ করেছে তা হলো অধিকাংশ ধর্ষণের শিকার ১৮ বছরের নিচের শিশু কন্যা এবং বেশির ভাগ অপরাধীরাও তরুণ।
তিনি বলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি হলো নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করে কথা বলা, অধস্তন করে রাখা। নারীর প্রতি সহিংসতার শতকরা ৭০ ভাগই পারিবারিকভাবে হয়। নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেশে আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। আদালতে যায় মাত্র শতকরা তিন ভাগ।
সীমা মোসলেম আরো বলেন, দেশের অর্থনীতিতে নারীদের অবদান অনেক। তারা কোন কিছুতে পিছিয়ে নেই, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র নারীর পাশে নেই। অঘটন ঘটলেই সুশীল সমাজের অঙ্গুলি নারীর বিরুদ্ধেই যায়। নারীর প্রতি সহিংসতা যে মানবাধিকার লঙ্ঘন তা উপলব্ধি করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ না হলে সমাজ এগুতে পারবেনা। শিক্ষা কারিকুলামে নারী নিপীড়ন প্রতিকারের উপায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বর্তমানে জার্মানিতে অবস্থান করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক জোবায়দা নাসরীন কণা। তিনি ভার্চুয়ালী যুক্ত হয়ে তার গবেষণা থেকে নারী নির্যাতনের আদ্যোপান্ত বিস্তারিত ব্যাখা করেন।
তিনি এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে বলেন, ধর্ষণের শিকার অধিকাংশ কন্যা শিশু। জোবায়দা নাসরিন বলেন, পিতৃতন্ত্র যতদিন আছে ততদিন নারী নিপীড়ন বন্ধ হবেনা। কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেই নিন্দা বা বিচারের আগে আলোচনায় আসে, আগে বেশি হয়েছে না বর্তমানে বেশি হচ্ছে। রাজনৈতিক রূপ দেয়া হয়। ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয় বের করার জন্য অনেকে ব্যস্ত হয়ে পরে। একজন উপদেষ্টা কিভাবে বলতে পারেন মুরাদনগরের ধর্ষনের ঘটনা ঘটিয়েছেন একটি রাজনৈতিক দলের লোক। ধর্ষণের বিরুদ্ধে রাজনীতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্ষণকে বৈধতা দেয়া হয়। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামের নেতারা যখন নারীকে বেশ্যা হিসেবে গালি দেয়, রাষ্ট্র সেখানে নিশ্চুপ থাকে।
যোবায়দা নাসরিন আরো বলেন, আমার জানা মতে এই সপ্তাহে ১৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে যা সংবাদপত্রে আসেনি। এখন ভয়ের রাজত্ব চলছে। সংবাদপত্র সেলফ সেন্সরশিপ করে থাকে। তিনি বলেন, ধর্ষণের সাথে অর্থনীতির যোগ আছে। ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবার বেশির ভাগ সময়ে এলাকা ছেড়ে চলে যায়, তখন অন্যেরা তাদের ভিটেবাড়ি দখল করে নেয়। গত ২৬শে জুন মুরাদনগরে যে হিন্দু নারীর উপর ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে, সেই পরিবারটিও এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে নারীর প্রতি ন্যাক্কারজনক নীপিড়ন, বর্বরোচিত সহিংসতা, সারাদেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা ও এর প্রতিকারে আরো যারা জোড়ালো বক্তব্য রাখেন তারা হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা গৌস সুলতান, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মুসা হাসান, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মাহমুদ এ রউফ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা ড. আনসার আহমেদ উল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আ্যলামনাই ইন দা ইউকের সভাপতি প্রশান্ত পুরকায়স্থ বিইএম, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি সৈয়দ এনামুল ইসলাম, সত্যবাণী অনলাইন পোর্টালের সম্পাদ্ক সৈয়দ আনাস পাশা, কবি হামিদ মোহাম্মদ, সাংবাদিক নিলুফা ইয়াসমীন হাসান, অভিনেত্রী কবি মাহফুজা রহমান, কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব এমদাদ তালুকদার, সাংবাদিক মকিস মনসুর, সাংস্কৃতিক কর্মী উপস্থাপক ঊর্মি মাযহার প্রমুখ।
‘মানুষ তুমি জেগো উঠো মানবতায়’ গান পরিবেশন করেন মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠযোদ্ধা হিমাংশু গোস্বামী ও ‘জাগো মানুষ জাগো শক্তি কর সঞ্চয়’ গান পরিবেশন করেন বিশিষ্ট শিল্পী গৌরী চৌধুরী।
নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেছেন সাংস্কৃতিক কর্মী শাহাবুদ্দিন আহমেদ বাচ্চু ও ময়নূর রহমান বাবুল। প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইকবাল ‘নৈসর্গের চিৎকার’ কবিতা আবৃত্তির পাশাপাশি বলেন, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ঘুমিয়ে থাকা, উৎকর্ষতার জন্য তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সাংস্কৃতিক কর্মী বাচিক শিল্পী মহুয়া চৌধুরী অনেক আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন, পরবর্তীতে নারী জাগরণ নিয়ে চমৎকার আবৃত্তি করেছেন।
প্রায় প্রতি দিনই নারীর উপর অমানবিক অত্যাচারের খবর সংবাদপত্রের শিরোনাম হচ্ছে। উল্লেখ্য, যে ঘটনাটি বিশেষভাবে আলোড়ন তুলেছে তা হলো, গত ২৬শে জুন কুমিল্লার মুরাদ নগরে এক পাষন্ডের ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হিন্দু রমণী। পরবর্তীতে এক দল উশৃঙ্খল যুবক ভুক্তভোগী নারীকে প্রহার করে মারাত্মকভাবে আহত করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁকে বিবস্র করে ভিডিও ধারণ করে, এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয়। এই নিন্দণীয় ঘটনার পরের দিনই ভোলাতে গণ ধর্ষণের শিকার হন অপর এক নারী। অমানবিক আচরণের শিকার এই নারী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন এই নৃশংস ঘটনার পর তিনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন।
গতকাল ৬ই জুলাই আরো একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, তা হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে মসজিদ থেকে ৯ বছরের শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, পুলিশের ধারণা ধর্ষণের শিকার হয়েছে শিশুটি। এই ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত হচ্ছে।
’ছান্দসিক’ আয়োজিত নারী নির্যাতন বিরোধী ভার্চুয়ালী অনুষ্ঠানে যোগ দানকারী সকলে এই পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
বিষয়: #কন্যা #চৌধুরী #নারী #পার #বর্তমান #বাংলাদেশ #ভয়াবহ #মতিয়ার #শিশু #সময়