

মঙ্গলবার ● ৮ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » বিশেষ » কক্সবাজারের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যবইয়ের বাইরে পাঠাভ্যাস গড়ার গুরুত্ব
কক্সবাজারের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যবইয়ের বাইরে পাঠাভ্যাস গড়ার গুরুত্ব
আদিল ইলাহি::
বর্তমান বিশ্বে একটি জাতির উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন। আর এই জ্ঞান আহরণের অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে পাঠাভ্যাস। পাঠ্যবইয়ের সীমিত পাঠ জ্ঞানার্জনের একটি ভিত্তি মাত্র, কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর চিন্তা, কল্পনা, বিশ্লেষণ, মনন ও মানবিক গুণাবলি গড়ে ওঠে যখন সে পাঠ্যবইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে পাঠাভ্যাসের বিশাল দুনিয়ায় পা রাখে। এই প্রেক্ষাপটে কক্সবাজার জেলার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠ্যবইয়ের বাইরে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা সময়োপযোগী ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উদ্যোগ।
পাঠ্যবইয়ের বাইরে পাঠ মানে কী?
বাংলাদেশে অনেকেই মনে করেন পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়া মানেই গল্প, কবিতা বা উপন্যাস পড়া। অথচ বাস্তবে এই পাঠাভ্যাসের পরিধি অনেক বিস্তৃত। এতে রয়েছে জীবনী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক বই, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, আত্মউন্নয়ন, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধভিত্তিক রচনাসমূহ, এমনকি গবেষণাধর্মী লেখাও। এইসব পাঠ শিক্ষার্থীদের শুধু জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধই করে না, বরং তাদের মননশীলতা, সহমর্মিতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা, ভাষাশৈলী এবং আত্মবিশ্বাসের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বর্তমান বাস্তবতায় পাঠাভ্যাসের চিত্র:
দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিক্ষার্থীর মাঝে বই পড়ার অভ্যাস দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউব এবং গেমিং অ্যাপসের প্রলোভনে তারা পড়াশোনার বাইরের সময়গুলো কাটায় স্ক্রিনে ডুবে থেকে। এটি শুধুমাত্র তাদের মনোযোগ হ্রাসই করছে না, বরং চিন্তনশীলতা ও ভাষাগত দক্ষতার অভাবও তৈরি করছে। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারে—“স্কুলের পড়া তো ঠিকমতো করি, তাহলে আর কী দরকার?” অথচ বাস্তবতা হলো, পাঠ্যবইয়ের বাইরের পাঠ একটি শিক্ষার্থীকে শুধু পরীক্ষায় পাশ করার যোগ্য নাগরিক নয়, বরং একজন সচেতন, চিন্তাশীল ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।
কক্সবাজারের প্রেক্ষাপটে সমস্যার ধরণ:
কক্সবাজার বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় অঞ্চল—ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, পর্যটন, সামুদ্রিক সম্পদ ও মানবিক চেতনার দিক থেকে এই অঞ্চলের আলাদা পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে এখনও অনেক ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। বেশিরভাগ স্কুল ও কলেজে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পাঠাভ্যাস তৈরিতে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। লাইব্রেরি থাকলেও সেগুলো হয় অকার্যকর, পুরনো বইতে ঠাসা, অথবা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক সংগ্রহে ভরা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও পাঠচক্র, সাহিত্যআলোচনা, অথবা নিয়মিত বইপড়া কর্মসূচি খুব একটা সক্রিয় নয়।
শিক্ষার্থীর অভ্যাস গঠনে প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা:
একজন শিক্ষার্থী কোনো অভ্যাস গড়ে তোলে তার চারপাশের পরিবেশ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মনোভাব, শিক্ষক ও অভিভাবকের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থীদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলে, তার প্রতিক্রিয়া সংগ্রহ করে, আলোচনা করে, তাহলে ধীরে ধীরে ওই প্রতিষ্ঠানে পাঠাভ্যাস গড়ে উঠবে।
শুধু শিক্ষকদের ওপর নির্ভর না করে—প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে “বই পড়া ঘন্টা”, “সাহিত্যচক্র”, “আলোচনা সভা”, “বই উপস্থাপন প্রতিযোগিতা”, “পাঠ প্রতিক্রিয়া” আয়োজন করা যেতে পারে। এছাড়া, স্থানীয় লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও গবেষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আলাপচারিতা বইয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করবে।
পাঠাভ্যাসের উপকারিতা:
পাঠ্যবইয়ের বাইরে নিয়মিত পাঠাভ্যাস শিক্ষার্থীদের জন্য যে উপকার বয়ে আনে তা বহুমাত্রিক—
· চিন্তা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা বাড়ে
· ভাষার উপর দখল ও লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি পায়
· আত্মবিশ্বাস ও উপস্থাপনার যোগ্যতা তৈরি হয়
· সৃষ্টিশীলতা ও কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে
· নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি তৈরি হয়
· ভবিষ্যতের কর্পোরেট বা একাডেমিক জগতে প্রতিযোগিতামূলক দক্ষতা তৈরি হয়।
কীভাবে গড়ে তোলা যেতে পারে পাঠাভ্যাস?
✅ বিদ্যালয়ে সক্রিয় ও আপডেটেড লাইব্রেরি স্থাপন
✅ মাসে একবার বই রিভিউ ক্লাস বাধ্যতামূলক করা
✅ পিতামাতা ও অভিভাবকদের সাথে আলোচনা—বাসায় বই কেনার অভ্যাস তৈরি করা
✅ পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারে সাহিত্য মেলা ও বইমেলা আয়োজন
✅ বিদ্যালয়-কলেজে ‘পাঠ প্রতিযোগিতা’ও পুরস্কার চালু করা
✅ ডিজিটাল লাইব্রেরি বা ই-বুকের সহজ প্রবেশগম্যতা
পাঠ্যবইয়ের বাইরের পাঠ কেবল একটি ‘অতিরিক্ত‘ কাজ নয়—এটি একটি ‘মানুষ গড়ার’ প্রক্রিয়ার অন্যতম স্তম্ভ। কক্সবাজারে শিক্ষার প্রসারে শুধু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়, বরং সেইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যবইয়ের বাইরের জগতে প্রবেশের পথ তৈরি করাও জরুরি। পাঠাভ্যাসের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা হোক চিন্তাশীল, মানবিক এবং আত্মবিশ্বাসী মানুষ—এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখক: আদিল ইলাহি
শিক্ষক, ইংরেজি বিভাগ
কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
বিষয়: #কক্সবাজার #কলেজ #গুরুত্ব #গড়া #পাঠাভ্যাস #পাঠ্যবই #বাইরে #বিশ্ববিদ্যালয় #স্কুল