

শুক্রবার ● ২ মে ২০২৫
প্রথম পাতা » প্রবাসে » বাংলাদেশের অর্থনীতির সূর্য হয়ে জ্বলে যারা, উপেক্ষিত তারা
বাংলাদেশের অর্থনীতির সূর্য হয়ে জ্বলে যারা, উপেক্ষিত তারা
বজ্রকণ্ঠ ডেস্ক::
বাংলাদেশের অর্থনীতির বুকে এক নীরব, নিঃস্বার্থ যোদ্ধার নাম—প্রবাসী শ্রমিক। যারা প্রিয় মাতৃভূমি, পরিবার ও স্বজনদের ছেড়ে দূরদেশে পাড়ি জমায় শুধু একটি আশায়—ভবিষ্যতের জন্য একটু নিরাপদ আশ্রয়, একটু সুখের সন্ধান। আজ তারা সংখ্যায় প্রায় এক কোটি, কিন্তু এই সংখ্যার পেছনে লুকিয়ে আছে লাখো চোখের জল, ভাঙা স্বপ্ন আর সহস্র ত্যাগের গল্প।
প্রবাসে শ্রম জীবনের সূচনা
বিদেশ যাত্রা হয় কারও কাছে স্বপ্ন, কারও কাছে শেষ আশ্রয়। বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চল থেকে উঠে আসা অগণিত যুবক মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপের কিছু দেশে পাড়ি দেন, হাতে থাকে দালালের দেওয়া প্রতিশ্রুতির এক টুকরো কাগজ, আর মায়ের চোখের শেষ দোয়াভরা চাহনি।
কিন্তু স্বপ্নপূরণের আগেই শুরু হয় প্রতারণা, হয়রানি আর শোষণ। দালালের মাধ্যমে যেতে গিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়েন; কেউ বসতবাড়ি বিক্রি করেন, কেউ জমি বন্ধক রাখেন। অথচ বিদেশে গিয়ে দেখা যায়, সেই চুক্তির কাজ নেই, নেই বেতন কিংবা নিরাপত্তা। অজানা ভাষা, অপরিচিত সংস্কৃতি—সব মিলিয়ে শুরু হয় তাদের জীবনের নতুন সংগ্রাম।
প্রবাসে জীবন: ঘাম, অশ্রু ও নিঃসঙ্গতা
এই সংগ্রাম শুধুই আর্থিক নয়, এটি এক ভয়ানক আবেগের যুদ্ধ। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি টানা ১২-১৪ ঘণ্টা সূর্যের তাপে পুড়ে, ধুলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে তারা কাজ করেন। পায়ের নিচে গরম বালি, পিঠে অসহ্য ব্যথা, চোখে ঘুম নেই—তবুও মুখে হাসি রেখে তারা ভিডিও কলে সন্তানের খোঁজ নেন।
কেউ মাসের পর মাস বেতন পান না, কেউ আহত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকেন। চিকিৎসা নেই, সান্ত্বনা নেই—শুধু একাকিত্বের দীর্ঘ রাত। বিশেষ করে গৃহকর্মীরা অনেক সময় শারীরিক নিপীড়ন, লাঞ্ছনার শিকার হন, কিন্তু ন্যায়বিচারের আশায় প্রহর গোনেন ব্যর্থতায়।
প্রবাসীর অর্থে দেশের চাকা সচল
যদিও তারা হাজারো কষ্টে থাকেন, তবুও প্রতি মাসে তারা দেশে পাঠান ভালোবাসা ভরা অর্থ—যা কেবল টাকা নয় বরং এক ধরনের আত্মত্যাগ। সেই টাকা দিয়ে মায়ের চিকিৎসা হয়, ভাইয়ের পড়ালেখা হয়, ঘর মেরামত হয়, বোনের বিয়ে হয়। বাংলাদেশে পাঠানো অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে অক্সিজেন দেয়, অর্থনীতিকে গতিশীল রাখে, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পেছনে এক নীরব চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে।
যথাযোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত নীরব এই বীরেরা
দুঃখজনক হলেও সত্য—এই নীরব বীরেরা ফিরে আসার পর পায় না প্রাপ্য মর্যাদা। বিমানবন্দরে নামে এক বুক আশা নিয়ে, কিন্তু সম্মান নয়—পায় অবজ্ঞা, হয়রানি। ইমিগ্রেশনে অবহেলা, কাস্টমসে দুর্ব্যবহার, ব্যাংকে অবজ্ঞা আর সমাজে কটূক্তি যেন তাদের নিয়তি।
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে খুব কমক্ষেত্রেই তাদের অবদানকে স্মরণ করা হয়। না কোনো জাতীয় দিবসে, না কোনো উন্নয়ন উৎসবে তাদের কথা উঠে আসে। অথচ এই মানুষগুলোই দেশের অর্থনীতির সূর্য হয়ে জ্বলে, নিজের জীবন নিঃশেষ করে দেশের আলো বাড়িয়ে দেয়।
উপেক্ষিত ‘অহংকারের প্রতীক’
বিদেশে অনেকেই শুধু শ্রমিক নয়, হয়ে উঠেছেন দেশের মুখ। তারপরও বাংলাদেশি প্রবাসীরা অনেক সময় ভিসা সমস্যায়, আইনি জটিলতায়, দূতাবাসের উদাসীনতায় ভোগেন। দূতাবাসের দরজায় গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন, কিন্তু সাড়া পান না।
দেশে ফিরেও দেখা যায় না কোনো দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি, না মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন—সবকিছুতেই যেন তারা অবাঞ্ছিত। অথচ তাদের পাঠানো টাকা দিয়ে দেশে গড়ে উঠছে অগণিত স্বপ্ন, শহরে ছুটছে ট্রেন, সেতুর ওপর দিয়ে চলে গাড়ি, কিন্তু সেই সেতুর পিলারে যে এক প্রবাসীর ঘাম লেগে আছে, তা কেউ মনে রাখে না।
সম্ভাবনার দ্বার খুলতে প্রয়োজন সহানুভূতি ও নীতিগত পরিবর্তন
এই মানুষেরা সম্মান চান, দয়া নয়। চান সুষ্ঠু প্রক্রিয়া, ন্যায়বিচার, নিরাপদ কর্মস্থল। প্রথমেই দালালচক্রের দমন জরুরি। শ্রমিকদের প্রাক-প্রশিক্ষণ, সঠিক তথ্য ও বৈধ পথে বিদেশগমনের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
বিদেশে অবস্থানকালে দূতাবাসগুলোকে হতে হবে প্রকৃত অভিভাবক। দেশে ফিরে যারা ফিরে আসছেন, তাদের জন্য পুনর্বাসন, দক্ষতা প্রশিক্ষণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবাও চালু করা আবশ্যক।
প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধারা আমাদের অর্থনীতির অক্টেন, তারা আমাদের সমাজের ছায়াবৃক্ষ। তাদের হাত ধরেই দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি টিকে আছে, শহরের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে। তাদের কষ্ট শুধু কষ্ট নয়, তা একেকটি ইতিহাস—একেকটি আত্মত্যাগের মহাকাব্য।
তাদের চোখের জল আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত, তাদের ঘামের বিনিময়ে গড়ে ওঠা সেতু আমাদের গর্ব হওয়া উচিত। তাদের প্রাপ্য শুধু টাকা নয়—প্রাপ্য সম্মান, ভালোবাসা, ও শ্রদ্ধা। তারা আমাদের নীরব গর্ব, তাদের প্রতি দায়িত্ব এখন আমাদের।
বিষয়: #অর্থনীতির #উপেক্ষিত #জ্বলে #তারা #বাংলাদেশের #যারা #সূর্য #হয়ে
