শনিবার ● ২২ নভেম্বর ২০২৫
প্রথম পাতা » আলোকিত ব্যক্তিত্ব » ভ্রমণকার শাকুর মজিদ বহুমাত্রিক সত্তার জন্মদিনে সৃষ্টিশীলতার মহোৎসব !
ভ্রমণকার শাকুর মজিদ বহুমাত্রিক সত্তার জন্মদিনে সৃষ্টিশীলতার মহোৎসব !
কবি ও সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন রনি ::
![]()
বাংলাদেশের সংস্কৃতি, লোকজ ঐতিহ্য, মানবিক গল্প ও প্রান্তিক মানুষের স্বপ্নকে যারা চোখে দেখা দৃশ্য থেকে জীবনের গল্পে রূপ দেন, তাঁরাই হয়ে ওঠেন সময়ের রচয়িতা। বহুমাত্রিক প্রতিভা, নীরব গভীরতা এবং অন্তর্দীপ্ত সৃষ্টিশীলতার অনন্য সংমিশ্রণ—শাকুর মজিদ ঠিক এমনই এক স্রষ্টা।
২২ নভেম্বর আজ তাঁর জন্মদিন। কিন্তু এই দিনটি শুধু একজন মানুষের জন্মদিন নয়; এটি যেন বাংলা ভাষা, বাংলা লোকসংস্কৃতি এবং ভাটির মাটির ভাষাকে নতুন করে আবিষ্কারের এক উৎসব।
শাকুর মজিদ—নামটি উচ্চারণ করলেই উঠে আসে এক বহুবর্ণিল জগতের ছবি। কখনো তিনি স্থপতি, পরম যত্নে আঁকছেন রেখা ও স্থান বিন্যাসের নীলনকশা; কখনো তিনি ক্যামেরার উজ্জ্বল চোখ, যিনি দৃশ্যকে ধরে রাখেন সময়ের সিন্দুকে; কখনো তিনি গল্পকার, আত্মজৈবনিক স্মৃতিকে রূপ দিচ্ছেন স্বপ্ন পাখির যাত্রায়; আবার কখনো তিনি ভ্রমণকার, যিনি অজানা জনপদের রোদ, নদী, পাহাড়, মানুষের হাসি-কান্না নিয়ে ফেরেন নিজের কাহিনীতে। সময় পরম্পরায় তিনি হয়ে উঠেছেন এক অনবদ্য সৃজন–মানচিত্র, যাকে ঘিরে আজ বাংলা সংস্কৃতি ও সৃষ্টিশীলতার আলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
লোকসংস্কৃতির গভীরে এক অন্তর্লীন অভিযাত্রা
বাংলাদেশের বাউল, ফোক–সংস্কৃতি, ভাটির গানের আবহ দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্য ও গবেষণার পরিধিতে থাকলেও শাকুর মজিদের কাজ এগুলোকে এনে দিয়েছে অন্য মাত্রার দৃশ্যমানতা।
শাহ আব্দুল করিমের জীবন, শিল্প, দার্শনিক সুর—যা একসময় অনেকে ছুঁয়ে দেখতেও সাহস করতেন না—তাকে তিনি তুলে করেছেন মূলধারার অঙ্গনে। বাউল করিমকে বুঝতে হলে এখন আর শুধু গান শোনা যথেষ্ট নয়; বুঝতে হয় তাঁর জীবনের সেই নীরব সংগ্রাম, যা শাকুর মজিদ তাঁর চলচ্চিত্র, প্রবন্ধ ও ডকুমেন্টারিতে এমনভাবে তুলে ধরেছেন যেন দর্শক নিজের চোখেই দেখছেন সেই সুরের জন্ম হতে থাকা দুঃখ–আনন্দ।
লালনের দর্শনকে তিনি দেখিয়েছেন সহজ অথচ গভীর ভাষায়—যেখানে কোনো সাঁজোয়া তত্ত্ব নেই, আছে মানুষের ভেতরকার মুক্তির পথ। হাছন রাজার অশরীরী সুর, তাঁর আধ্যাত্মিক নিঃসঙ্গতা, তাঁর প্রেমের অনির্বচনীয়তা—এসবই শাকুর মজিদের নির্মাণে যেন আরও মূর্ত, আরও হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে।
লোকসংস্কৃতিকে তিনি দেখাননি কেবল ঐতিহ্যের উপাদান হিসেবে; দেখিয়েছেন মানুষ হিসেবে। দুঃখ, ঘাম, মুখের রেখা, ভাটির রোদ কিংবা সুরমার জলের ঢেউ—সবই তাঁর গল্পে চরিত্র হয়ে ওঠে।
ক্যামেরার চোখে মানুষ ও প্রকৃতির সংলাপ
শাকুর মজিদের চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারি শুধু দৃশ্যায়ন নয়—এগুলো জীবনের সঞ্চার। তাঁর ক্যামেরা কখনো নিঃশব্দ, কখনো প্রশ্নমুখর, কখনো আবার মানুষের অন্তরস্পর্শী। গ্রামীণ বাংলার মাটি, জলের গন্ধ, কাঠুরেদের যাতায়াত, নদীর ওপারে মানুষের অপেক্ষা, কিংবা হাওরের নৌকায় বসে থাকা নীরবতাও তাঁর ক্যামেরায় কথা বলে। কোথাও কোনও বাড়তি সাজসজ্জা নেই—আছে সত্য।
তিনি দৃশ্য দেখান না; দেখার চোখ দেন। যে চোখে দর্শক দেখেন নিজের ভেতরটাকে। সংস্কৃতির শিকড়, মানুষের স্থায়কামিতা, অথবা মানবিক বেদনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আনন্দ—সবই তাঁর কাজের বুননে বহমান। ক্যাডেট কলেজ থেকে বুয়েট: মানুষ হয়ে ওঠার পথ অনেকে শাকুর মজিদকে কেবল লেখক বা চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে চেনেন, কিন্তু তাঁর ক্যাডেট কলেজের কঠোর দিনগুলো কিংবা বুয়েটের স্থাপত্যজীবন তাঁর সৃষ্টিশীল চেতনার ভিত রচনা করেছে খুব গভীরে। তাঁর লেখায় এই দিনগুলো ফিরে আসে স্মৃতির আবরণে নয়, বরং জীবন হয়ে—যেখানে অনুশাসনের কাঠিন্য আর বন্ধুত্বের কোমলতা পাশাপাশি থাকে।
তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে একজন মানুষ প্রতিদিন একটু একটু করে বদলে ওঠে। কীভাবে শৈশব–কৈশোরের আবদ্ধতা একসময় মুক্ত আকাশে ছড়িয়ে যেতে শেখায় তাকে।
বন্ধুত্ব, প্রতিযোগিতা, শিক্ষকদের কঠোর দৃষ্টি, পরীক্ষার ভয়, আবার হঠাৎ বিকেলের মাঠে উড়ে যাওয়া কোনো স্বপ্নপাখির গল্প—সবই তাঁর আত্মজৈবনিক রচনায় ধরা পড়ে নির্মোহ অথচ আন্তরিকভাবে।
অজানা পথের ভ্রমণকার যেখানেই গেছেন—দেশে বা বিদেশে—শাকুর মজিদ ভ্রমণকে শুধু যাত্রা হিসেবে দেখেননি। তিনি দেখেছেন মানুষ হিসেবে, প্রাণ হিসেবে, ইতিহাসের ধারক–বাহক হিসেবে।
তাঁর ভ্রমণ–গদ্যে নদী শুধু নদী নয়, সে সময়ের প্রতীক; পাহাড় শুধু প্রকৃতির রূপ নয়, মানুষের সংগ্রামের অনন্ত উচ্চতা; অজানা জনপদ শুধু স্থান নয়, মানুষের অগণিত গল্পের ধারক। তিনি দেখান—ভ্রমণ মানে শুধু চোখে দেখা নয়; ভ্রমণ মানে নিজেকে দেখা। নিজের অজানাকে চিনে ফেলা। নতুন দেশ নয়, নতুন মানুষ হয়ে ফিরে আসা।
বন্ধুত্বের অন্তরঙ্গতায় এক আলোকস্তম্ভ শাকুরকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তারা বলেন—তিনি এক আলোকস্তম্ভ। কারও উপর আলো ফেলে তাকে অন্ধ করে দেন না; বরং নরম আলোয় পথ দেখান। তাঁর বন্ধুত্ব প্রভাব ফেলে, প্রশ্রয় দেয়, আবার চিন্তা করতেও বাধ্য করে।
“বন্ধু” শব্দের চেয়েও গভীর অর্থে তিনি অনেকের জীবনে শিক্ষক, অনুপ্রেরণা, এবং পথদর্শক হয়ে আছেন। গভীর মনন, নীরব শ্রোতা হওয়ার ক্ষমতা, মানুষের গল্প শোনার অদ্ভুত মনোযোগ—এসব মিলেই তাঁর চারপাশে সৃষ্টি হয় এক বিশেষ আভা, যা মানুষের সৃজনশীলতাকে উজ্জীবিত করে।
জন্মদিনের তাৎপর্য: নতুন গল্পের জন্ম আজ তাঁর জন্মদিন। মনে হচ্ছে—এটি একজন মানুষের জন্মদিন নয়; এটি যেন আরও কিছু গল্পের জন্মদিন। আরও কিছু পথের, আরও কিছু সুরের, আরও কিছু ভাটির গানের পুনর্জন্ম।
তিনি যত লিখবেন, যত নির্মাণ করবেন, যত ভ্রমণ করবেন—ততই আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে। তাঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে যেন মনে হয়—আমরা তাঁকে শুধু উদ্যাপন করছি না, উদ্যাপন করছি আমাদের শিল্প–চেতনার নতুন অধ্যায়কে, আমাদের মানুষের গল্পকে, আমাদের নদী–হাওয়া–গ্রাম বাংলার মাটিকে।
বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যারা দীর্ঘদিন কাজ করছেন, তারা বলেন—শাকুর মজিদ এক ধরণের সেতু। শহর ও গ্রাম, পরিশীলিত সংস্কৃতি ও লোকজ ঐতিহ্য, উচ্চশিক্ষিত প্রজন্ম ও শিকড়–নির্ভর সাধারণ মানুষ—সবার মধ্যে এক যোগসূত্র তৈরি করেছেন তিনি। এ কারণেই তাঁর সৃষ্টির আবেদন ব্যাপক। তাঁর কাজ শহরের পাঠক–দর্শকের কাছে যেমন গ্রহণযোগ্য, তেমনি গ্রামবাংলার মানুষও তাঁর চলচ্চিত্রে নিজের জীবনকে খুঁজে পায়।
তিনি দেখিয়েছেন—সত্যিকারের শিল্পী সেই, যে সকল মানুষের চোখে-হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারে। সৃষ্টিশীলতার আলো আরও দূরে যাক
শাকুর মজিদের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে অনেকে বলেন—তিনি যেন আরও দূরে যান। আরও গভীরে প্রবেশ করেন মানুষেরঅন্তর্লোকের, লোকসংস্কৃতির, প্রকৃতির, ইতিহাসের। কারণ তাঁর প্রতিটি যাত্রা ফিরে আসে নতুন রূপে, নতুন আলোতে, নতুন গল্প হয়ে।
বাংলা ভাষা তাঁর হাতে আরও স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। গ্রামবাংলার দৃশ্য আরও জীবন্ত হয়। মানুষের হাসি, কান্না, স্বপ্ন—সবই তাঁর কলম আর ক্যামেরায় পায় নতুন অর্থ। জন্মদিন মানে নতুন আলো, নতুন পথচলা আজ তাঁর জন্মদিনে মনে হয়—জন্ম হচ্ছে শুধু একজন মানুষের নয়, জন্ম হচ্ছে আরও কিছু সৃষ্টির। আরও কিছু লোকগানের। আরও কিছু হারিয়ে যাওয়া সুরকে ফিরে পাওয়ার।
আজকের এই দিনটি নিছক ক্যালেন্ডারের নয়; এটি সৃজনশীলতার নতুন দিগন্তে পা রাখার দিন।
শাকুর মজিদ—আপনি যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ফিরে আসেন আমাদের শব্দ, দৃষ্টি এবং স্বপ্নের জগতে। জন্মদিনের অগাধ শুভেচ্ছা।
বিষয়: #জন্মদিন #বহুমাত্রিক #ভ্রমণকার #মজিদ #মহোৎসব #শাকুর #সত্তার #সৃষ্টিশীলতার




স্মরণে সাংবাদিকতার প্রথিক জেড এম শামসুল: সাদাসিধে জীবনে আলোর দিশারী
ফকির দুর্ব্বিন শাহ: ভাটি বাংলার মরমি বাউল সাধক
ড. আজিজুল আম্বিয়া পেলেন “গ্লোবাল প্রপার্টিজ এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড 2025″
মাহরিন চৌধুরী: সোনার হরফে লেখা অনন্য শিক্ষকের নাম
“বিশিষ্ট সমাজসেবক, আলহাজ্ব জয়নাল হোসেন এর মৃত্যুতে একাটুনা ইউনিয়ন ফাউন্ডেশন অব মৌলভীবাজার এর শোক প্রকাশ;
অনুষ্ঠিত হয়েছে সদ্য প্রয়াত সিলেটের বিশিষ্ট কবি মুকুল চৌধুরী ও প্রাবন্ধিক সিরাজুল হক স্মরণে স্মরণ সভা।
লোকসংস্কৃতি গবেষক আবু সালেহ আহমদ এর ধারাবাহিক গ্রন্থ আলোচনা-০৩ ভালোবাসার বহিরাবরণ: গ্রন্থটি সমাজ, প্রেম ও মানবজীবনের প্রতিচ্ছবি..। আলোচক- কবি এম আর ঠাকুর।
মৌলভীবাজারের কবি, লেখক, সাংবাদিক সৌমিত্র দেবের স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত
আলোকময় মানুষ। আলো জ্বালানোর কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
