

মঙ্গলবার ● ৫ আগস্ট ২০২৫
প্রথম পাতা » বিশেষ » গণঅভ্যুত্থান ও গণ-আকাঙ্ক্ষা: এক বছরে অর্জনটা কী?
গণঅভ্যুত্থান ও গণ-আকাঙ্ক্ষা: এক বছরে অর্জনটা কী?
ড. মাহরুফ চৌধুরী :::
২০২৪ সালের ৫ই জুলাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক গভীর রাজনৈতিক বিজয়ের দিন। বহু বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, অসন্তোষ ও অবদমিত আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এই দিনে সংঘটিত ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ গণঅভ্যুত্থানে। গণতন্ত্রের নামে জগদ্দল পাথরের মত রাষ্ট্রের বুকের উপর চেপে বসা স্বৈরাচারী ও বৈষম্যমূলক শাসন, শোষনের বিরুদ্ধে এই গণজাগরণ কেবল একটি সরকার পতনের আন্দোলন ছিল না। বরং এটি ছিল একটি নৈতিক, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার দাবিতে জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ এবং নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণে সুতীব্র আকাঙ্ক্ষার বহির্প্রকাশ। এই গণঅভ্যুত্থানে ন্যায়ের পক্ষে অন্যায়ের বিপক্ষে তরুণদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল প্রতিরোধের রাজপথ। আর তার মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছিল এক স্বপ্নতাড়িত ভবিষ্যতের হাতছানি একটি শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, মানবিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের গণআকাঙ্ক্ষা। তাই সংগত কারণেই স্বৈরাচারী দানবীয় শাসকের পতনের বর্ষপূর্তিতে দেশের প্রতিটি নাগরিকের প্রশ্ন: গত এক বছরে আমাদের অর্জনটা কী?
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই গণঅভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটায়নি, বরং তা ছিল একটি কলুষিত সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠার জন্য সামাজিক চেতনার রূপান্ত রের সূচনাও। সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘পরিবর্তনের রহস্য হলো তোমার সমস্ত শক্তি পুরনোকে মোকাবেলা করার পিছনে নয়, বরং নতুনকে গড়ে তোলার কাজে নিয়োজিত করা’। তাই পুরাতনকে ভেঙে ফেলে বাংলাদেশের মানুষও যেন সে দিন নতুন কিছু গঠনের দিকে অগ্রসর হতে চেয়ে ছিল। কিন্তু আজ এক বছর পর যদি ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করা যায়, সেই স্বপ্নের কতটুকু বাস্তবায়ন ঘটেছে? তার জবাব মেলা ভার। বাস্তবতা হলো, একবছর পরও দেশ এখনো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একটি অস্পষ্ট, অনির্ধারিত ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বৈরশাসনের অবসানের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা পূরণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সৃষ্টি হয়েছে অস্থিরতা। পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনিক দক্ষতার অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা দিয়েছে সমন্বয়হীনতা। তার উপরে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো এবং সরকারি প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোতে বিদ্যমান সুবিধাবাদীদের অসহযোগিতা ও নানা চক্রান্ত।
দেশের সাধারণ মানুষ আশা করেছিল যে, রাষ্ট্র নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাবে জনকল্যাণ, স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের পথে। কিন্তু বহুক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পূর্বতন শাসনব্যবস্থার ছায়া এখনো নানাভাবে থেকে যাচ্ছে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসমূহে। এই বাস্তবতা আমাদেরকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করে: গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পৃহা ও গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতি আমরা যথাযথ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে পেরেছি কি? এই এক বছরে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বিপ্লবের অনিবার্য অভিঘাত। একদিকে ছিল জনগণের বিজয়ের উল্লাস, ক্রোধ ও স্বেচ্ছাচারিতার বহির্প্রকাশ, আর অন্যদিকে ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা হারানো শাসক ও শোষক শ্রেণী এবং তাদের দোষরদের ক্রোধ, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রুদ্র প্রতিক্রিয়া। অপরদিকে সরকারের অভিজ্ঞতাহীনতা, অদূরদর্শিতা ও সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যর্থতা আভ্যন্তরীন ও বর্হিশক্তিগুলোকে সুযোগ করে দিয়েছে প্রতিনিয়ত সরকারের পরিবর্তন প্রয়াসী কর্মকান্ডে বাধা সৃষ্টি করতে এবং জনমনে সন্দেহ ও হতাশা সৃষ্টি করতে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতা ও প্রতিবন্ধকতা তথা রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের সদ্বিচ্ছার অভাব।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী হওয়া উচিত ছিল এমন এক সংকটময় মুহূর্তে? ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (১৯২৬-১৯৮৪) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অদৃশ্য ও সূক্ষ্ম বলপ্রয়োগ নিয়ে যে আলোচনা করেছেন, তা আমাদের দেশের এই বাস্তবতার সঙ্গে গভীরভাবে মিলে যায়। জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে নজরদারি, দমন ও ভয়ের কৌশল ব্যবহৃত হয়, তা এক ধরনের ‘জৈবশাসন’ (বায়োপাওয়া) প্রতিষ্ঠা করে যা মানুষকে বেঁচে থাকতে দেয়, কিন্তু তাদের অধিকারহীন করে তোলে। তাই দীর্ঘকাল নিপীড়নে অভ্যস্ত দেশে এই এক বছরে কেবল একটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তন নয়, বরং আমরা দেখেছি নাগরিক মর্যাদা ও মানবাধিকারের জন্য একটি নির্মম পরীক্ষা হিসেবে।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক রূপরেখায় দেশের অভ্যন্তরে যে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়, তা ছিল ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নতুন সম্ভাবনা ও বিপদের যুগপৎ প্রতিচ্ছবি। গণআন্দোলনের জোয়ারে পতিত পুরাতন ক্ষমতাকাঠামোর শূন্যতা পূরণে এই অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে এমন এক মুহূর্তে, যখন দেশবাসী শুধু নেতৃত্ব নয়, বরং যুগান্তকারি সঠিক দিকনির্দেশনার প্রতীক্ষায় ছিল। অস্থায়ী সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষিত হয় একটি সংস্কারমুখী রাজনৈতিক রূপরেখা, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন, বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহিতামূলক রূপান্তর এবং একটি সময়োপযোগী ও গণতান্ত্রিক সংবিধান সংস্কারের অঙ্গীকার। কিন্তু অচিরেই সংস্কার প্রচেষ্টাগুলোকে ঘিরে দেখা দিয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, এবং অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ। বহুক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও তার কার্যকর বাস্তবায়ন হয়নি সময়মতো, ফলে জনগণের মধ্যে হতাশা ও আস্থার সংকট তৈরি হতে শুরু করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণযোগ্য হয়ে ওঠে ইটালীয় মার্ক্সবাদী দার্শনিক গ্রামশির (১৮৯১-১৯৩৭) কথাটি, ‘পুরাতন মারা যাচ্ছে এবং নতুনের জন্ম হতে পারে না; এমনই একটি শূণ্যতার মাঝে বিভিন্ন ধরণের অসুস্থ লক্ষণ দেখা দেয়’। বাংলাদেশ রূপান্তরের এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে পুরাতন কাঠামো ভেঙে পড়লেও নতুন কাঠামো স্থাপন অনিশ্চিত ও বিভ্রান্তিকর। অর্থাৎ সংস্কারের ঘোষণাগুলোতে ভবিষ্যতের এক রূপরেখা স্পষ্ট থাকলেও, তার বাস্তবায়নের পথ কণ্টকাকীর্ণ। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনগণের প্রত্যাশার মাঝে যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও প্রকট হচ্ছে।
গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন। সরকারও সেই দাবি স্বীকার করে একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দেয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ পুনর্গঠন, স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রণয়ন, প্রযুক্তিনির্ভর অবাধ ভোটগ্রহণ পদ্ধতি চালু এবং সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তবে বাস্তবে এই রূপরেখার বাস্তবায়ন নানা প্রতিবন্ধকতায় স্থবির হয়ে পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। কমিশনের সদস্য মনোনয়নে স্বচ্ছতা ও সর্বদলীয় পরামর্শের অভাব, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কথিত হস্তক্ষেপ এবং অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে জনগণের ভেতর গভীর সংশয় সৃষ্টি করেছে। একাধিক রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং প্রক্রিয়াটি নিয়ে প্রকাশ্যে মতপার্থক্য দেখিয়েছে। ফলে একটি সম্মিলিত, সর্বদলীয় রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও জটিলতায় বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের একাংশ ‘পেছন থেকে চাপ’ তথা অপ্রকাশ্য প্রভাব ও অদৃশ্য শক্তির হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছে, যা নির্বাচনী সংস্কারের নির্ভরযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
২০২৬ সালের পূর্বনির্ধারিত জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। নির্বাচনকালিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামো ও নেতৃত্ব নিয়ে এখনো একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব আসেনি। কিছু রাজনৈতিক দল চাইছে নির্দলীয় প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন, অন্যরা চাইছে একটি রাজনৈতিক অথচ নিরপেক্ষ কার্যনির্বাহী কর্তৃপক্ষ। এই মতানৈক্য দূর করতে কার্যকর সংলাপের অভাব এবং পারস্পরিক আস্থাহীনতা প্রক্রিয়াকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে। এ প্রেক্ষাপটে ভারতের সংবিধান বিশেষজ্ঞ বি. আর. আম্বেদকরের (১৮৯১-১৯৫৬) অভিমত প্রণিধানযোগ্য, ‘গণতন্ত্র কেবল সরকারের একটি রূপ নয়। এটি মূলত সম্পৃক্ত জীবনযাত্রার একটি পদ্ধতি’। অর্থাৎ প্রকৃত গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়, বরং তা একটি সামাজিক চুক্তি ও পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে গঠিত একটি সমবায় কাঠামো। সেই কাঠামো তৈরির জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক আন্তরিকতা, বিবেকবান রাষ্ট্রচিন্তা এবং সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্যের অভাব কেবল একটি সাংবিধানিক সংকট নয়, বরং গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে একটি গভীর অন্তরায় হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তি কেবল নির্বাচনের অধিকার নয়, বরং নাগরিক জীবনের সার্বিক নিরাপত্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং পারস্পরিক সহনশীলতার চর্চা। এই ভিত্তিগুলোর ওপর দাঁড়িয়েই একটি রাষ্ট্র তার ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র রক্ষা করে। ইংরেজ দার্শনিক ও রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩) বলেছিলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে একটি রাষ্ট্রের মূল্য নির্ধারিত হয় সেই রাষ্ট্র বির্নিমাণকারী ব্যক্তিদের মূল্যের ভিত্তিতে’। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মূল্য নির্ধারিত হয় তার নাগরিকদের মর্যাদা ও অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত হয় তার ভিত্তিতে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায়, নাগরিকদের নিরাপত্তা, পরমত সহিষ্ণুতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে এখনও বাংলাদেশ একটি পরিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারেনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার উদ্যোগগুলো যদি যথাযথ স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা শুধু কাগুজে উন্নয়ন নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে একটি টেকসই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভিত রচনা করতে পারে। যদি সংস্কারপ্রয়াসগুলোর উদ্দেশ্য হয় জনগণের ক্ষমতায়ন এবং রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থার পুনর্গঠন, তবে সেগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে হয়তো ধীরে ধীরে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারবে এবং একটি অধিকতর সুসংহত, জবাবদিহিমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
সব কিছু মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, চব্বিশের জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের এক বছর প রেও বাংলাদেশ এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে অতীতের রক্তাক্ত স্মৃতি, বর্তমানের অনিশ্চয়তা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে দেশের রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণের দিকে তাকিয়ে আছে। একদিকে আছে তরুণদের আত্মদান, শহীদের রক্তে লেখা স্বপ্ন, ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার সাহসী উচ্চারণ; আর অন্যদিকে রয়েছে প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনৈতিক দ্বিধা, নীতিনির্ধারণে অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে দোদুল্যমান এক রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে একটি কার্যকর, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র কেবল একটি শাসনপ্রণালী নয়, এটি একটি বিশ্বাসের কাঠামো যেখানে মানুষের মত, মর্যাদা ও অধিকারই রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। এই বিশ্বাসকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা, সিদ্ধান্তগ্রহণে দূরদর্শিতা, প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা, এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় ও সচেতন অংশগ্রহণ।
একটি গণঅভ্যুত্থান যত বড় শক্তি ও উৎসর্গের দাবি করুক না কেন, তা যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরে ব্যর্থ হয় তবে ইতিহাস তাকে ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’ হিসেবে চিহ্নিত করে। অতীতে বারবারই আমরা সেই বেদনার ইতিহাস বহন করেছি, এবং এ অভিজ্ঞতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পরিবর্তনের প্রকৃত প্রাপ্তি নির্ভর করে সেই পরিবর্তনের সদ্বিচ্ছা, পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, রূপায়ণ ও মানবিকীকরণের ওপর। এই বাস্তবতায়, রাষ্ট্র যদি আবারও গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে অবহেলা করে, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে, তবে তা কেবল একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, বরং এটি হবে একটি নৈতিক ও ঐতিহাসিক ব্যর্থতা যার দায় কেবল সরকারের নয়, পুরো জাতির উপর বর্তাবে। সুতরাং এই যুগসন্ধিক্ষণে প্রয়োজন সাহসী সিদ্ধান্ত, দায়িত্বশীল নেতৃত্ব এবং একটি মৌলিক বোধ যা নিশ্চিত করবে গণতন্ত্র শুধু ক্ষমতার পথ নয়, এটি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর একমাত্র পথ।
বৈষম্যহীন ও স্বৈরাচারমুক্ত রাষ্ট্রের জন্য গণআন্দোলনটি হয়েছিল একটি নতুন সূর্যোদয়ের আশায়; এমন একটি ভোরের জন্য, যেখানে স্বাধীনতা কেবল একটি রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং প্রতিটি মানুষের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। সেই কাঙ্ক্ষিত আলো হয়তো এখনো পুরোপুরি দেখা যায়নি, তবুও তার এক ক্ষীণ আভা বাতাসে এখনও ভেসে বেড়ায় কখনো শহীদ মিনারের মাথা তুলে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকায়, কখনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবাদী ছাত্রের চোখের তীব্র চাহনীতে, আবার কখনো দূর কোন গ্রামে কোনো কৃষকের স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর নিঃশ্বাসে। এখন সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত চেতনার ওপরই এই আভাকে জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব নির্ভর করছে। তাই আজ প্রয়োজন এমন একটি ঐক্যবদ্ধ সামাজিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যা দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করতে শেখাবে, আর উদ্বুদ্ধ করবে এই বিশ্বাসে যে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড় এবং দলের চেয়ে রাষ্ট্র আরো বড় বিষয়। সময়ের প্রয়োজনে আমরা এমন নেতৃত্ব প্রত্যাশা করি, যা কেবল ক্ষমতা চায় না, বরং মানুষের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে শেখে আর ‘দেশ ও দশের’ সামষ্টিক কল্যাণে নিজেকে উতসর্গ করে। সাথে সাথে প্রয়োজন এমন একটি নৈতিক ভিত্তি তৈরি করা যেখানে রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ই ন্যায়, মানবতা ও গণতান্ত্রিক মর্যাদাকে অগ্রাধিকার দেয়।
পরিশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশ আজ যে সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি নীরবতা, এমনকি প্রতিটি দৃষ্টিপাতও ভবিষ্যতের পথরেখা নির্ধারণ করে দেবে। এই যুগসন্ধিক্ষণ নিছক একটি রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক মোড় নয়। এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়, ন্যায়বোধ ও সম্মিলিত ভবিষ্যতের সন্ধান। এই মুহূর্তে আমরা যা করছি কিংবা করছিনা, তা-ই নির্ধারণ করবে আগামী দিনগুলোতে আমাদের ইতিহাস কোন দিকে বাঁক নেবে। যে আলো আমরা এক বছর আগে রাজপথে বুকের রক্তে জ্বালিয়েছিলাম, তা যেন নিভে না যায় কোনো উদাসীনতায়, গা-ছাড়া নিষ্ক্রিয়তায় বা কৌশলী নীরবতার আঁধারে। আমাদের সকলের দায়িত্ব এই আলোকে শুধু স্মরণ নয়, বরং রক্ষা করা, লালন করা। কারণ এই আলোর মধ্যে নিহিত আছে জনগণের আত্মত্যাগ, তরুণদের স্বপ্ন, আর একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের প্রত্যয়। আমরা যদি এই পথচলায় সাহস, সততা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি, তবে আগামী প্রজন্ম কোনো ভোরবেলায় ফিরে তাকিয়ে গর্বভরে বলতে পারবে: ‘হ্যাঁ, আমাদের পূর্বসূরিরা স্বপ্ন দেখেছিল; এবং সেই স্বপ্নকে সত্যি করতে তারা পিছপা হয়নি’। আর তখনই হয়তো আমাদের এই সংগ্রাম, এই ত্যাগ, এই ভবিষ্যতের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণের আশার আলো হয়ে উঠবে সত্যিকার অর্থে ঐতিহাসিক।
* লিখেছেন: ড. মাহরুফ চৌধুরী, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।
বিষয়: #আকাঙ্ক্ষা #গণ #গণঅভ্যুত্থান