শিরোনাম:
ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ৫ পৌষ ১৪৩২
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বজ্রকণ্ঠ "সময়ের সাহসী অনলাইন পত্রিকা", সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঢাকা,রাজশাহী,নিউ ইয়র্ক,লন্ডন থেকে প্রকাশিত। লিখতে পারেন আপনিও। বজ্রকণ্ঠ:” সময়ের সাহসী অনলাইন পত্রিকা ” আপনাকে স্বাগতম। বজ্রকণ্ঠ:: জ্ঞানের ঘর:: সংবাদপত্র কে বলা হয় জ্ঞানের ঘর। প্রিয় পাঠক, আপনিও ” বজ্রকণ্ঠ ” অনলাইনের অংশ হয়ে উঠুন। আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি ” বজ্রকণ্ঠ:” সময়ের সাহসী অনলাইন পত্রিকা ” কে জানাতে ই-মেইল করুন-ই-মেইল:: [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।

Bojrokontho
রবিবার ● ৩ আগস্ট ২০২৫
প্রথম পাতা » বিশেষ » চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান: বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগরণ
প্রথম পাতা » বিশেষ » চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান: বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগরণ
১২৭ বার পঠিত
রবিবার ● ৩ আগস্ট ২০২৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান: বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগরণ

ড. মাহরুফ চৌধুরী
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান: বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগরণ
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শুধু একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ফল নয়, বরং এটি ছিল দীর্ঘকাল ধরে সমাজে জমে ওঠা বঞ্চনা, বৈষম্য ও স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে এক বিশাল গণজাগরণের বিস্ফোরণ। এই সময় দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, নগর থেকে গ্রাম পর্যন্ত হাজার হাজার তরুণ-তরুণী, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক, পেশাজীবী এবং সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল প্রতিবাদের স্লোগান, চোখেমুখে ছিল নিপীড়নের বিরুদ্ধে জেদি প্রত্যয়, আর হৃদয়ে বহমান ছিল একটি ন্যায়ের সমাজের স্বপ্ন- একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা।
এই আন্দোলনের মর্মমূলে নিহিত ছিল দুটি শব্দ: ‘বৈষম্যহীন’ ও ‘স্বৈরাচারমুক্ত’। শব্দ দুটো নিছক শ্লোগা নের শব্দ ছিল না, বরং তার পেছনে ছিল দশকের পর দশক ধরে সঞ্চিত এক নিঃশব্দ আর্তনাদ, যা এ প্রজন্মের মুখে এসে উচ্চারিত হলো বিদ্রোহের ভাষায়। এই দ্বৈত দাবির মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে সেই জনমানস, যাদের প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবতা হয়ে উঠেছিল বৈষম্যমূলক অর্থনীতি, রাজনৈতিক নিপীড়ন, এবং ন্যায়বিচারহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার নির্মমতার শিকার হওয়া। চিন্তাবিদ ফ্রান্‌ৎস ফ্যাননের ভাষায়, যখন উপনিবেশ বা দমনমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা একটি জনগোষ্ঠীর আশা ও স্বপ্নকে দাবিয়ে রাখে, তখন সেই জনগোষ্ঠী বিদ্রোহকেই জীবনের স্বাভাবিক পথ হিসেবে বেছে নেয়। চব্বিশের বাংলাদেশ যেন সেই ফ্যাননীয় বাস্তবতারই প্রতিফলন।
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণআন্দোলনকে প্রায়ই রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের সূচক হিসেবে দেখা হয়। এই প্রেক্ষাপটে, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ছিল এক প্রকার নৈতিক প্রতিরোধ যা শুধুই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং তা ছিল একটি নতুন ধরনের সমাজ গঠনের স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমবেত আকাঙ্ক্ষা। এ গণঅভ্যুত্থান প্রশ্ন তোলে পূর্ববর্তী শাসকদের বৈধতা নিয়ে, তেমনি নতুন ভবিষ্যতের প্রতি দায়বদ্ধতাও সৃষ্টি করে। এই আন্দোলন তাই শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনাই ছিল না; এটি ছিল একটি সমাজ-সাংস্কৃতিক গতিধারার নতুন বাঁক, যেখানে একটি নতুন প্রজন্ম তার অতীতের সকল ব্যর্থতার দায়ভার ঝেড়ে ফেলে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মমর্যাদার দাবিতে আত্মপ্রকাশ করে। এটি ছিল ইতিহাসের সেই ক্ষণ, যখন বহু শোষিত, নিঃস্ব, ও অপদস্থ মানুষ একযোগে বলেছিল, ‘আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে’।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রথম দৃশ্যমান প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিলেন এই আন্দোলনের সূচক ও চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রায়শই ছাত্রসমাজই প্রথম আওয়াজ তোলে। যেমনটি আমরা দেখেছি ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে, কিংবা ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। ২০২৪-এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু এই আন্দোলনের ভিত্তিভূমি ছিল পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় অনেক বেশি জটিল ও বহুমাত্রিক। এটি শুধু ধনী-দরিদ্রের আর্থিক ব্যবধানের প্রশ্ন ছিল না; বরং এর গভীরে ছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাঠামো শক্তির অপব্যবহার ও রাজনৈতিক আনুগত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বৈষম্য, যা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মানবিক মর্যাদাকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছিল।
সরকারি চাকরিতে দলীয়করণ, উচ্চশিক্ষায় রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়া, কোটা ব্যবস্থার নামে একপাক্ষিক সুবিধাবণ্টন, এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারকে অবহেলা করার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছিল একটি পক্ষপাতদুষ্ট ও অনৈতিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব থাকা স্বাভাবিক হলেও, যখন সেই দায়িত্ব কৃতজ্ঞতার গণ্ডি পেরিয়ে একচোখা সুযোগসন্ধানী ব্যবস্থায় পরিণত হয় তখন সেটি বৈষম্যের রূপ পরিগ্রহ করে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিল: যদি রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক সমান মর্যাদার অধিকারী হয়, তবে কেন জন্মপরিচয়, রাজনৈতিক পরিচয় কিংবা সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী তার শিক্ষার অধিকার বা চাকরির সুযোগ নির্ধারিত হবে?
এখানে আমরা জন রলসের ‘ন্যায়বিচারের তত্ত্ব’ (থিওরী অব জাস্টিস)-এর কথা স্মরণ করতে পারি, যেখানে তিনি বলেন, একটি ন্যায্য সমাজ গঠনের জন্য সবচেয়ে দুর্বল এবং সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু তা হতে হবে সার্বজনীন নীতির আলোকে, পক্ষপাতহীনভাবে। চব্বিশের ছাত্ররা যেন রলসের এই নৈতিক দর্শনকেই বাস্তবে প্রতিফলিত কর তে চেয়েছিল। তাঁরা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে নয়, বরং পুরো সমাজব্যবস্থার ভেতরকার সাংগঠনিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকে উৎসারিত এই বিদ্রোহ তাই নিছক রাজনৈতিক নয়; এটি ছিল এক ধরনের নৈতিক অভ্যুত্থান। এখানে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থের চেয়ে বৃহত্তর সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন প্রাধান্য পেয়েছে। তরুণদের চোখে ধরা পড়েছে যে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ছাড়া উন্নয়ন কেবল একটি পরিসংখ্যানগত ছলনা। সেই উপলব্ধি থেকেই তারা নিজেদের ক্লাসরুমের সীমা ছাড়িয়ে রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছিল, মানবিক মর্যাদা, সমতা ও সুবিচারের দাবিতে দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিল, ‘এই বৈষম্য করা চলবে না’।
ছাত্রদের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করে সরকার যখন কঠোর ও দমনমূলক অবস্থান নেয়, তখন আন্দোলন একটি নতুন মোড় নেয়। এটি হয়ে ওঠে কেবল একটি দাবিদাওয়া নির্ভর প্রতিবাদ নয়, বরং এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণের সুতীব্র প্রতিরোধ। এ আন্দোলনের গন্তব্য ছিল না কেবল আর্থিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের অবসান; বরং এর লক্ষ্য ছিল সেই রাষ্ট্রীয় মানসিকতা ও কাঠামোর বিরুদ্ধাচরণ, যেখানে জনতার চেয়ে ক্ষমতাই মুখ্য, যেখানে নাগরিক অধিকার নয়, বরং আনুগত্যই একমাত্র গ্রহণযোগ্যতা। স্বৈরাচার এখানে কোনো ব্যক্তিনির্ভর অভিশাপ নয়, বরং একটি প্রতিষ্ঠানিক রূপান্তর- এক প্রকার শাসনতান্ত্রিক অন্ধকার, যার মূল চিহ্ন হলো ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতা, ভিন্নমতের দমন, এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর স্থলে কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ। প্লেটোর ‘দ্যা রিপাবলিক’-এ স্বৈরতন্ত্রের উৎপত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যখন জনগণের নিরাপত্তার নামে একটি শাসক ক্রমশ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে, তখন ধীরে ধীরে গণতন্ত্র সরে গিয়ে জন্ম নেয় স্বৈরাচার। চব্বিশের আন্দোলন যেন এই রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে বুঝে নিয়ে তার বিরুদ্ধে সময়োচিত ও নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছিল।
তরুণদের প্রতিরোধে ফুটে উঠেছিল প্রতীকী ও সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের এক নতুন ভাষা। কখনো তা ছিল দেয়ালে আঁকা ছায়াময় কবিতায়, কখনো তা ছিল হাত লেখা পোস্টারে, কখনো বা নিঃশব্দ প্ল্যাকার্ডে লেখা একটিমাত্র বাক্যে ধরা পড়ত গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের গণবিচ্ছিন্ন অপ্রত্যাশিত মূর্তি। এইসব অভিব্যক্তি ছিল সরাসরি রাষ্ট্রের ছায়াতলে শাসক শ্রেণীর দমননীতি ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে এক সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের অস্ত্র। তরুণদের এক একটি প্রশ্ন যেন রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তর্নিহিত সঙ্কটকে উন্মোচন করছিল: কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে? কেন সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করতে হয়? কেন মুক্তবুদ্ধির চর্চা রাষ্ট্রের কাছে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়? এই প্রশ্নগুলো শুধু প্রশাসনকে নয়, বরং গোটা সমাজকেই আত্মসমালোচনার মুখে দাঁড় করিয়েছিল। আন্দোলনকারীদের অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট, তারা কোনো আপোষে বিশ্বাস করেনি। ‘স্বৈরাচারকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না’ এই উচ্চারণ ছিল কেবল একটি স্লোগান নয়, বরং আন্দোলনে নামা নতুন প্রজন্মের নৈতিক শপথ। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোনো দেশে শুধু শাসক স্বৈরাচারী হয় না; সমাজও হয় স্বৈরতান্ত্রিক, আর সাধারণ মানুষের চিন্তাও হয়ে ওঠে দাসত্বে অভ্যস্ত। কিন্তু ২০২৪-এর এই প্রজন্ম সেই দাসত্বভীতি থেকে মুক্ত হয়ে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। তাদের অনিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর ছিল ভবিষ্যতের পক্ষে, ন্যায়বিচারের পক্ষে, এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে এক অনড় প্রতিরোধ।
সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে নবপ্রজন্ম যে আত্মদায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছে, তা নিছক নৈতিক অবস্থান নয় বরং ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এসে রক্তাক্ত প্রতিরোধের মাধ্যমে তারা ভবিষ্যতের পথচিহ্ন এঁকে দিয়েছে। চব্বিশের আন্দোলন তাই কেবল একটি রাজনৈতিক মোড় নয়, এটি ছিল এক জনজাগরণ, যা তরুণদের বিবেক ও চেতনার গভীরতম স্তর থেকে উৎসারিত। ‘স্বৈরাচার পতনের এক দফা’ এই উচ্চারণটি ছাত্র-জনতার মুখে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছিল এক সম্মিলিত সংগ্রামের শপথে। এ ছিল রাষ্ট্র যন্ত্রের আড়ালে বাসা বাধা স্বৈর শাসক ও জনগণের মধ্যকার বৈরী সম্পর্কের বিরুদ্ধে একটি মৌলিক প্রতিবাদ, যেখানে তরুণেরা কেবল শিকার নয়, হয়ে উঠেছিল পরিবর্তনের কারিগর। এই অভ্যুত্থান আমাদের এক গভীর উপলব্ধির মুখোমুখি দাঁড় করায়, এই প্রজন্ম আর আগের মতো কেবল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তারা বইয়ের পাতার বাইরে সমাজের বাস্তবতা দেখে, অন্যায়ের মধ্যে সত্যকে খুঁজে পেতে চায়, এবং যখন দেখে যে তাদের চারপাশের কাঠামো ন্যায় থেকে বিচ্যুত, তখন তারা নীরব থাকতে অস্বীকার করে। ‘নিরব দর্শক’ হিসেবে বসে থাকা তাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং তারা এখন ইতিহাসকে নিজেদের হাতে রচনা করতে চায় নিজেদের রক্ত, স্বপ্ন ও সংগ্রামের ভাষায়।
নতুন প্রজন্মের এই জাগরণ শুধু রাজনৈতিক সচেতনতার ফল নয়; এটি এক গভীর নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের প্রতিফলন। ইতালীয় চিন্তাবিদ আন্তোনিও গ্রামশি যেমন ‘জৈবিক বুদ্ধিজীবী’ (অর্গানিক ইন্টালেকচুয়ালস)-এর কথা বলেন যারা সমাজের ভেতর থেকে উঠে এসে বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, সেই অর্থে বাংলাদেশের এই তরুণেরা এখন আর কেবল সুবিধাভোগী শ্রেণির মুখপাত্র নয়, বরং হয়ে উঠেছে সমাজ-রূপান্তরের চেতনা-প্রসূত প্রজ্ঞার বাহক। তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে এক বিকাশমান সাংস্কৃতিক বোধ, যা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা নয়, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাচর্চা এবং ভাষার ভেতরেও পরিবর্তন ঘটাতে চায়। তারা কেবল ‘পরিবর্তনের দাবি’ করছে না; বরং নিজেদের চিন্তা-চর্চা, আচরণ এবং প্রতিদিনের জীবনের ভেতরে সেই পরিবর্তনের বীজ রোপণ করছে। তাদের প্রতিবাদে যেমন আছে সংঘাতের তীব্রতা, তেমনি আছে সৃজনশীলতার দীপ্তি। এই প্রজন্ম কবিতা লেখে, গান বাঁধে, থিয়েটারে প্রশ্ন তোলে, ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে রঙ দিয়ে আঁকে ন্যায়ের আকাঙ্ক্ষা। তারা সমাজের প্রতিটি স্তরে পরিবর্তনের বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা একদিন একটি ন্যায্য, মানবিক রাষ্ট্রের ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। এই নৈতিক জাগরণ তাই কেবল স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক প্রতিবাদ নয় এটি এক সামাজিক নবজাগরণ, যা ব্যক্তি-মানসে মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি করছে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান একটি সাময়িক বিস্ফোরণ ছিল না; এটি ছিল ইতিহাসনির্মাণের এক সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার অনিবার্য প্রকাশ। বহু বছর ধরে সমাজের গহীনে জমে থাকা ক্ষোভ, যন্ত্রণা ও ন্যায়বোধ একসময় আন্দোলনের রূপ নেয় যেখানে কেবল ক্ষণিকের প্রতিবাদ নয়, বরং একটি বৃহত্তর নৈতিক-রাজনৈতিক চেতনার বিস্তার পরিলক্ষিত হয়। এই চেতনা অতীতের নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে থেমে থাকেনি; বরং তা আমাদেরকে ভবিষ্যতের দিকে নতুনভাবে তাকাতে শিখিয়েছে; একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক, ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রের কল্পনা সামনে এনেছে। এই আন্দোলন তাই কেবল একটি সময়কালীন ঘটনা নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে এক কালাতীত ইতিহাসের মাইল ফলক। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়, যে জাতি নিজের সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, ও চেতনার উত্তরাধিকার ভুলে যায়, সে জাতি স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে না। রোমান দার্শনিক সিসেরো একবার বলেছিলেন, ‘জন্মের আগে যা ঘটেছিল তা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা মানে সর্বদা শিশু থাকা’। তেমনি অতীত ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়াও কোন জাতিই পরিপক্ব হয়ে উঠতে পারে না। এই আন্দোলনের শিক্ষা তাই শুধু আবেগ নয়, বরং একটি বোধের আহ্বান—নাগরিকত্বের নৈতিক দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করা।
এই উত্তরাধিকার শুধু কিছু রাজনৈতিক নেতার হাতে তুলে দিয়ে আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং এই দায় সমাজের প্রতিটি বিবেকবান নাগরিকের, বিশেষত তরুণদের, যারা ভবিষ্যতের নির্মাতা। রাষ্ট্র, সমাজ এবং শিক্ষা— জাতীয় জীবনের এই তিনটি স্তম্ভের সম্মিলিত দায়বদ্ধতার মধ্য দিয়েই এই আন্দোলনের চেতনা স্থায়ী রূপ পেতে পারে। আজ যখন আমরা আবার নানা ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক দমননীতি, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, এবং বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মুখোমুখি হচ্ছি, তখন সবচেয়ে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই আন্দোলনের শিক্ষা ও প্রেরণাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করা। সমাজ বদলের দায়িত্ব কিছু নির্বাচিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নয়; এটি আমাদের সবার, বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের, যাদের কণ্ঠে ভবিষ্যতের স্বর ধ্বনিত হয়। তাঁদের প্রয়োজন আত্মসমালোচনার চোখে নিজেদের কর্মকান্ডকে দেখার, নৈতিক উপলব্ধিকে কাজে লাগানোর, এবং যেখানেই অন্যায়-অবিচার দেখা যায়, সেখানে নির্ভয়ে, দৃঢ়তায়, ও মানবিক দায়িত্বে রুখে দাঁড়ানোর। কারণ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোই একটি বিবেকবান প্রজন্মের প্রথম এবং অপরিহার্য দায়িত্ব।
২০২৪—এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়; এটি হয়ে উঠেছে একটি চেতনার নাম, একটি নৈতিক অবস্থান, একটি সময়ান্তরের প্রতীক। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইতিহাস কখনো শুধু ঘটনা দিয়ে লেখা হয় নাl লেখা হয় মানুষের সাহস, প্রতিরোধ এবং সত্য-ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি কণ্ঠের দ্বারা। সময় নীরব অথচ নিরপেক্ষ বিচারক হয়ে প্রতিবার ফিরে এসে আমাদের সামনে রাখে কিছু অবিরাম প্রশ্ন: কে ছিল অন্যায়ের পাশে, আর কে ন্যায়ের পক্ষে সাহস করে দাঁড়াতে পেরেছিল? এই প্রশ্নের উত্তর শুধু ইতিহাসবিদ বা রাজনৈতিক বিশ্লেষকের নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকের, প্রতিটি তরুণের, প্রতিটি শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী ও চিন্তাশীল মানুষের। আমাদের প্রত্যেককে এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। কারণ ইতিহাসের সবচেয়ে জরুরি অধ্যায়গুলো কখনো কেবল যুদ্ধে লেখা হয়নি, বরং লেখা হয়েছে মানুষের বিবেকের দীপ্তিতে।
যাদের হৃদয়ে এখনো সামান্য হলেও সাহস আছে, ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা আছে, সাম্যের প্রতি বিশ্বাস আছে—তাদের কেউই এই প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারে না। আলবেয়ার কামুর ভাষায়, ‘একটি শৃঙ্খলিত বিশ্বের সাথে মোকাবিলা করার একমাত্র উপায় হল এতটাই সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া যে তোমার অস্তিত্বই বিদ্রোহের ঘটনার মতো হয়ে উঠবে’। চব্বিশের চেতনা আমাদের সেই স্বাধীন সত্তা হয়ে ওঠারই ডাক দেয়। এটি এক প্রজন্মের বিবেক, এক জাতির আত্মমর্যাদা, এবং ভবিষ্যতের প্রতি এক প্রতিশ্রুতি যেখানে কেউই যেন নিরব দর্শক না থাকে, বরং সবাই হয়ে উঠুক অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক একটি জীবন্ত প্রতিবাদ। আজ যখন আমরা ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের কথা স্মরণ করি, তখন এই স্মরণ যেন কেবল একটি অতীত অধ্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শণ নয়, বরং সাথে সাথে হয়ে উঠুক ভবিষ্যতের প্রতি এক দৃপ্ত অঙ্গীকার। একটি মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক, এবং বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের যে স্বপ্ন এগণঅভ্যুত্থান আমাদের চোখে এনে দিয়েছে, সেই স্বপ্ন যেন প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে, চিন্তায় এবং প্রয়াসে বাঁচিয়ে রাখা হয়। এই স্মৃতি হোক আমাদের বিবেকের জাগরণ, চেতনার দীপ্তি এবং সামষ্টিক ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়।
* লিখেছেন: ড. মাহরুফ চৌধুরী, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।



বিষয়: #  #  #  #  #  #


বিশেষ এর আরও খবর

কেবল চেতনা নয়, চাই ঐক্য ও কাজ: কোন পথে বাংলাদেশ? কেবল চেতনা নয়, চাই ঐক্য ও কাজ: কোন পথে বাংলাদেশ?
১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল বানিয়াচং উপজলার কালাইনজুড়া এবং হলদারপুর গ্রামে পাকবাহিনীর বিমান হামলা ও কিছু স্মৃতিকথা। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল বানিয়াচং উপজলার কালাইনজুড়া এবং হলদারপুর গ্রামে পাকবাহিনীর বিমান হামলা ও কিছু স্মৃতিকথা।
একটি বিশেষ প্রতিবেদন গানে গানে সংস্কারের কথা বলে গেছেন বাউল কামাল পাশা একটি বিশেষ প্রতিবেদন গানে গানে সংস্কারের কথা বলে গেছেন বাউল কামাল পাশা
মুক্তিযুদ্ধ : ছাতকের ‘শিখা সতেরো’—৫৪ বছরের রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধ : ছাতকের ‘শিখা সতেরো’—৫৪ বছরের রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি
সুনামগঞ্জে ১২৪ তম জন্মবার্ষিকীর আলোচনা সভায় বাউল কামাল পাশাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দানের দাবী সুনামগঞ্জে ১২৪ তম জন্মবার্ষিকীর আলোচনা সভায় বাউল কামাল পাশাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দানের দাবী
গানে গানে সংস্কারের কথা বলেছেন বাউল কামাল : ১২৪ তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী গানে গানে সংস্কারের কথা বলেছেন বাউল কামাল : ১২৪ তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী
কোকা-কোলা বাংলাদেশের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন মঈন উল্লাহ চৌধুরী কোকা-কোলা বাংলাদেশের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন মঈন উল্লাহ চৌধুরী
বাংলাদেশে ৭মাত্রার ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা  ধ্বংশ হয়ে যেতে পারে দেশের ৮০% স্থাপনা বাংলাদেশে ৭মাত্রার ভূমিকম্পের আগাম সতর্কবার্তা ধ্বংশ হয়ে যেতে পারে দেশের ৮০% স্থাপনা
ভূমিকম্প পরবর্তী স্বাভাবিক হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ ভূমিকম্প পরবর্তী স্বাভাবিক হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ
ঐক্যের বার্তা নিয়ে ভেসপাবস-এর ফ্যামিলি নাইট ও ডিনার অভ্যর্থনা ঐক্যের বার্তা নিয়ে ভেসপাবস-এর ফ্যামিলি নাইট ও ডিনার অভ্যর্থনা

আর্কাইভ

সিলেট শহরের সকল হবিগঞ্জী --- --- --- --- --- --- ---
উন্নয়ন মানে শুধু বড় বড় স্থাপনা নয়, উন্নয়ন মানে মানুষের মুখে হাসি ফোটানো
ব্রেকিং নিউজ উসমান হাদি মারা গেছেন
ছাতকে শহীদ মিনারে বিতর্কিত স্লোগান, ৪৮ ঘণ্টা পার হলেও থানা প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতা !
হবিগঞ্জের বানিয়াচং সড়কে বিজয় দিবসের দিনে মোটরসাইকেল ও মিশুক গাড়ি সংঘর্ষে নিহত ১জন আহত ২।।
দৌলতপুরে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস পালন
রাঙ্গুনিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষকের মৃত্যু
গ্রেফতার দেখানো হলো সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে
শেখ হাসিনা ও কামালের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আপিল করল প্রসিকিউশন
নির্বাচন বানচাল ও অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করতেই টার্গেট কিলিং হচ্ছে: নাহিদ
মানবাধীকার অপরাধ মামলা