

মঙ্গলবার ● ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রথম পাতা » বিশেষ » সঙ্গীত চৰ্চা ও ধর্ম শিক্ষা: তর্ক-বিতর্কের জায়গাটি কোথায়?
সঙ্গীত চৰ্চা ও ধর্ম শিক্ষা: তর্ক-বিতর্কের জায়গাটি কোথায়?
ড. মাহরুফ চৌধুরী ::
অযথা উল্টাসিধা তর্ক-বিতর্ক করা আমাদের সামাজিক অভ্যাসের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। এজন্যই হয়তো বাংলা প্রবাদে আমরা তার প্রতিফলন দেখি, ‘নাই কাজ তো খৈ ভাজ’। অর্থাৎ কাজের কাজ ফেলে আমরা অনেক সময় অকাজ বা কুকাজে শক্তি, সামর্থ্য ও সময় ব্যয় করি। এর পেছনে রয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক দারিদ্র্য, যা দীর্ঘদিন ধরে জাতির চিন্তাধারা ও অভ্যাসকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে সব তর্ককে যে অমূলক বলা যায় তা নয়; কিছু তর্ক-বিতর্ক সমাজের কল্যাণে এবং সময়ের প্রয়োজন মেটাতে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে সঙ্গীত চর্চা ও ধর্ম শিক্ষা নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কও এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় আলোচনার অংশ। এক শ্রেণির মানুষ মনে করেন, সঙ্গীত মানেই ভোগবাদী সংস্কৃতি ও ধর্মবিরোধী আনন্দের উৎস; অন্যদিকে আরেক শ্রেণি বিশ্বাস করেন সঙ্গীত হলো মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। আসলে এই মতভেদ তৈরি হয়েছে একে অপরের দৃষ্টিভঙ্গিকে যথাযথভাবে অনুধাবন না করা এবং ব্যবহারিক প্রেক্ষাপটের ভিন্ন ব্যাখ্যা থেকে। সঠিকভাবে অনুধাবন করলে স্পষ্ট হয় যে, বিদ্যালয়ে সঙ্গীত চর্চা ও ধর্ম শিক্ষা পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে, যদি আমরা অন্তর্ভুক্তি ও সমন্বয়ের দৃষ্টিতে বিষয়টি বিবেচনা করি।
উপমহাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সঙ্গীত কখনো ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। এ অঞ্চলে মুসলিম সুফি দরবেশরা সঙ্গীতকে ব্যবহার করেছেন আধ্যাত্মিকতার উন্মেষের হাতিয়ার হিসেবে। তাই আমরা দেখতে পাই, লালন শাহ, হাছন রাজা কিংবা ভাটিয়ালি গানের স্রষ্টারা ধর্ম ও দর্শনকে একসূত্রে গেঁথে মানবিক বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে। হিন্দু ঐতিহ্যে কীর্তন ও ভজন একইভাবে সঙ্গীতকে ভক্তির বাহন করেছে। ইসলামি সংস্কৃতিতেও ক্বাওয়ালি কিংবা হামদ-নাত ধর্মীয় চেতনার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে ওঠেছে। ফলে জীবনচর্যায় সঙ্গীতকে ধর্মের বিপরীতে দাঁড় করানো ইতিহাস ও বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গেই সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছে। ভক্তিমূলক গান, সুফি সঙ্গীত কিংবা কীর্তন সব ক্ষেত্রেই সঙ্গীতকে আধ্যাত্মিক উন্মেষের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিক্ষাক্রমে ধর্ম শিক্ষা আলাদা গুরুত্ব পাওয়ার পর পাঠ্যসূচিতে সঙ্গীতের অবস্থান অনেকের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে।
দর্শনের দিক থেকে সঙ্গীতকে বলা যায় নন্দনতত্ত্বের অনন্য অভিব্যক্তি। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো সঙ্গীতকে আত্মার উৎকর্ষ সাধনের এক মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। আবার আল-ফারাবি ও ইবনে সিনার মতো মুসলিম দার্শনিকরা সঙ্গীতকে জ্ঞানের একটি শাখা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। অন্যদিকে ধর্ম শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যদি হয় নৈতিক ও সৎ মানুষ তৈরি করা, তবে সঙ্গীতও সেই নৈতিকতা ও মানবিকতাকে অনুভব করার এক ভিন্নতর পথ হয়ে উঠতে পারে। এসব বিবেচনায় না নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যালয়ে সঙ্গীত চৰ্চা ও ধর্ম শিক্ষা নিয়ে অহেতুক তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ গভীরভাবে ভেবে দেখলে বিষয়টি এতটা জটিল মনে হওয়ার কথা নয়। রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম সাধারণত রাষ্ট্রীয় দর্শন, উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যের ভিত্তিতে তৈরি হয়। এতে যেমন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে, তেমনি অন্যান্য সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অধিকার ও অন্তর্ভুক্তির বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়। মানবিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় একে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌল নীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, গণতান্ত্রিক পরিবেশে শিক্ষা হলো ‘সামাজিক চুক্তির বাস্তব বা ফলিত রূপ’ যেখানে সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটে, পাশাপাশি সংখ্যালঘুর অধিকারও সুরক্ষিত থাকে।
মূলত সঙ্গীত চর্চা ও ধর্ম শিক্ষাকে পরস্পর বিরোধী করে সমস্যা সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ব্যাখ্যার ভিন্নতা এবং পরমতসহিষ্ণুতার অভাব। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, কেউ কেউ সঙ্গীতকে কেবল ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রতিফলন হিসেবে দেখেন, আবার অন্যরা তা মনে করেন সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা বা সত্য-সুন্দরের অনুসন্ধানের মাধ্যম। যদি ধর্মের উদ্দেশ্য হয় মানুষকে ন্যায়ের পথে চালিত করা, আর সঙ্গীত যদি হয় অন্তরের সত্যকে প্রকাশ, তবে এ দুইয়ের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো সংঘাত থাকার কথা নয়। বরং শিক্ষার্থীদের সামনে সঙ্গীত ও ধর্ম শিক্ষা দুটোকেই সুষমভাবে উপস্থাপন করা গেলে সমাজে মানবিকতা, সহমর্মিতা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। আজকের বাংলাদেশে আমাদের মুখ্য প্রশ্ন হওয়া উচিত, দায় ও দরদের ভিত্তিতে দেশ ও দশের কল্যাণে অন্তর্ভুক্তিমূলক যে সমাজ আমরা বির্নিমাণ করতে চাই, সেই প্রেক্ষাপটে এই বিতর্ককে আমরা কীভাবে দেখব? সঙ্গীত চর্চা ও ধর্ম শিক্ষা দু’টোকেই সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সব বিষয়ে অযথা বিতর্ক বা দ্বন্দ্ব তৈরি করলে তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে এবং জাতীয় ঐক্যের প্রচেষ্টা দুর্বল হয়ে পড়বে। সে যাই হোক, সঙ্গীতকে যদি আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উৎকর্ষের চর্চার সঙ্গে যুক্ত করে দেখা যায়, তবে শিক্ষার পরিসর হবে আরও সমৃদ্ধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুমাত্রিক।
বর্তমান বাংলাদেশে বিদ্যালয় পর্যায়ে সঙ্গীত চর্চা ও ধর্ম শিক্ষা দুটি আলাদা ধারায় এগোচ্ছে। যারা সঙ্গীত চর্চায় কিংবা শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে চান, তারা সাধারণ বিশেষ সঙ্গীত বিদ্যালয়ে তা করে থাকে। জাতীয় শিক্ষাক্রমে সঙ্গীতের জন্য সীমিত পরিসরে সুযোগ থাকলেও মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যসূচিতে কুরআনের শুদ্ধ উচ্চারণ ও তেলওয়াতের প্রসঙ্গ বাদ দিলে সঙ্গীতের কোনো স্থান নেই বললেই চলে। কিন্তু তারতিলের সাথে কুরআন পড়ার অনুশীলন সঙ্গীতের নানা বিষয়ের সাথে সুচারুভাবে অনুরূপ। সেসব তাত্ত্বিক কথা আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। সে যাই হোক, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষদের কেউ কেউ সঙ্গীতকে অগ্রহণযোগ্য বা এমনকি ‘পাপ’ হিসেবে দেখে। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষাধারায় পড়ুয়াদের একটি বড় অংশ সঙ্গীতকে ধর্মীয় বা নৈতিক চর্চার বিষয়বস্তু করার চেয়ে কেবল বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করছে। এর ফলে দুই ধারার শিক্ষার্থীর মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত ফারাক ক্রমশ বাড়ছে। অথচ মনোবিজ্ঞান ও শিক্ষাবিজ্ঞানের গবেষণা দেখায় সঙ্গীত শিশু-কিশোরদের কল্পনাশক্তি, আত্মবিশ্বাস, সহমর্মিতা ও সহনশীলতা গড়ে তোলে; যা ধর্ম শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক ও দায়িত্বশীল মানুষ গঠনের প্রচেষ্টার সঙ্গে পরিপূরক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। তাহলে প্রশ্ন হলো, বিদ্যালয়ে সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত কেন?
বিভাজনের প্রক্রিয়া হিসেবে সমাজে আজ একদিকে ‘সুকুমার বৃত্তির চর্চা’ আরেকদিকে ‘ধর্মীয় ও নৈতিকতার চর্চা’কে আলাদা করে দেখার বা দেখানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এ দৃষ্টিভঙ্গিগত বিভাজন তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে। অথচ আমাদের সমন্বয়বাদী বা মিলনমুখী দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই প্রমাণ করে, ধর্ম ও সঙ্গীতকে সমন্বয় করেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সঙ্গীতকে মানব-আত্মার মুক্তির উপায় হিসেবে দেখেছিলেন, আর কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সঙ্গীতে প্রেম ও বিদ্রোহের পাশাপাশি ধর্মীয় আবেগ অনুভূতি প্রকাশের ভেতর দিয়ে মানুষের মাঝে ন্যায় ও সাম্যের বার্তা ছড়িয়েছেন। এ দু’জনের কর্মের উদাহরণ থেকে দেখা যায়, সঙ্গীত ও ধর্ম পরস্পর বিরোধী নয়, বরং সহায়ক শক্তি হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে তাঁদের লেখনীতে। বাংলাদেশের মতো ধর্মপ্রাণ মানুষের সমাজে বিদ্যালয়ের আঙিনায় ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়া স্বাভাবিক এবং তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। কারণ মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে কেবল আইন নয়, প্রয়োজন ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিকতার ভিত্তি, যা অধিকাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানের জন্য প্রত্যাশা করেন।
আমাদের দেশে নানামুখী শিক্ষাধারার টানাপোড়নের আরেকটি বাস্তবতাও এখানে আছে, সেটা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে। যদি বিদ্যালয়ে ধর্ম শিক্ষা ন্যূনতম আকারে উপস্থিত না থাকে, তবে অনেক পরিবার তাদের সন্তানকে মূল ধারার শিক্ষায় না পাঠিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাধারার দিকে ঠেলে দেবে। অন্য ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ‘প্লাবন ঠেকাতে হলে ছোট ছোট খালকে সচল রাখতে হয়’। অর্থাৎ যারা মাদ্রাসা শিক্ষাধারার বিস্তারকে ঠেকাতে গলদঘর্ম, তাদেরকে অবশ্যই বিদ্যালয়েই যথার্থ ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করা প্রয়োজন। অপরদিকে আমাদেরকে এটিও মনে রাখতে হবে যে, সঙ্গীত একটি সুকুমার বৃত্তি, যা মানুষের অন্তর্গত মানবিকতাকে জাগ্রত করে, তার বোধকে শানিত করে এবং তাকে সংবেদনশীল করে তোলে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ও অ্যারিস্টটল পর্যন্ত সঙ্গীতকে রাষ্ট্রগঠনের মৌলিক উপাদান হিসেবে দেখেছিলেন। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে সঙ্গীত ইতিবাচক পন্থায় মানুষের চরিত্র গঠনে প্রভাব ফেলে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে সঙ্গীত চর্চা ও ধর্ম শিক্ষাকে সমান্তরাল নয়, বরং পরিপূরক ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা দরকার। শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে যে, ধর্ম শিক্ষা মানুষকে নৈতিক ভিত্তি দেয়, আর সঙ্গীত চর্চা সেই নৈতিকতাকে সৌন্দর্য, আবেগ ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে প্রকাশের সুযোগ করে দেয়। তবে এক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যও জরুরি, বিশেষ করে সঙ্গীত ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা। সঙ্গীতের চর্চায় আগ্রহ না থাকলে জোর করে তা চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষার্থীর স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হতে পারে। আবার ধর্ম শিক্ষা বাদ দিলে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক চাহিদার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করবে। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে যে, অভিভাবকদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে দ্বন্দ্ব বা সন্দেহ তৈরির সুযোগ নেই; বরং সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে সামষ্টিক কল্যাণকে প্রাধাণ্য দিয়ে সামঞ্জস্য ও সমন্বয়ের জায়গাই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
অযথা তর্ক-বিতর্কে না জড়িয়ে আমাদের উচিত সঙ্গীত চর্চাকে ধর্ম শিক্ষার বিপরীতে দাঁড় না করানো, কিংবা ধর্ম শিক্ষাকে সঙ্গীত চচার প্রতিদ্বন্দ্বী না বানানো। বরং প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত ও তাদের অভিভাবকদের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার। এক্ষেত্রে সম্পৃক্ত বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের উপর বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, যদি শিক্ষা সমাজের প্রতিফলন হয়, তবে তা স্বাভাবিকভাবেই সমাজের বহুমুখী চাহিদাকেও ধারণ করবে। যেসব বিদ্যালয়ে অভিভাবকেরা চাইবেন সেখানে সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যৌক্তিক ও আবশ্যিক হবে, আর যেসব বিদ্যালয়ে এ দাবি থাকবে না, সেখানে তা না করাই সমীচীন। অতএব বিদ্যালয় পর্যায়ে সঙ্গীত চর্চা ও ধর্ম শিক্ষা নিয়ে বিরোধ নয়, সহাবস্থানমূলক ও সমন্বয়ধর্মী সমাধান খোঁজা প্রয়োজন। মানবসভ্যতার ইতিহাস প্রমাণ করে, ধর্ম ও শিল্প (সুকুমার বৃত্তি) এই দুই ধারাই মানুষের মানসিক, নৈতিক ও নান্দনিক বিকাশের প্রধান উৎস। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটিকে চাপিয়ে দিলে জাতির সামগ্রিক বিকাশ ও অগ্রগতি ব্যাহত হবে। তাই প্রয়োজন ভারসাম্য, বস্তুনিষ্ঠতা এবং সর্বোপরি শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য তথা আগামী প্রজন্মকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দিকে গুরুত্ব দেওয়া। সঙ্গীত মানুষের অন্তরে সৌন্দর্য, সংবেদনশীলতা ও মানবিকতার বোধ জাগ্রত করে, আর ধর্ম শিক্ষা তাকে নৈতিকতা, দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতার মাধ্যমে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। এ দুইয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমেই আমরা পারি একটি আলোকিত, সহনশীল ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। তাই বিতর্ক নয়, রাষ্ট্রীয় আদর্শ ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য’কে অঙ্গীকার করে অন্তর্ভুক্তি, সহাবস্থান ও সমন্বয়ই হওয়া উচিত শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অগ্রাধিকারের কেন্দ্রবিন্দু।
* লিখেছেন: ড. মাহরুফ চৌধুরী, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য।
বিষয়: #চৰ্চা #তর্ক #ধর্ম #শিক্ষা #সঙ্গীত