

মঙ্গলবার ● ২৯ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » ছাতকে গায়েবি প্রশিক্ষণে সরকারি কর্মকর্তার পকেটে!
ছাতকে গায়েবি প্রশিক্ষণে সরকারি কর্মকর্তার পকেটে!
ছাতক (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি:
সুনামগঞ্জের জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা এজেএম রেজাউল আলমের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম দুনীতি ও ভুয়া ভাউচার জমা ২৫ লাখ টাকা আত্নসাতের ঘটনায় সুনামগঞ্জ জেলাজুড়েই ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দা ঝড় বইছে। প্রশিক্ষণ হয়নি কোনো উপজেলাতেই। অথচ প্রশিক্ষণের ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে কয়েক লাখ টাকা তুলে নিজের পকেট ভারি করেছেন জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা এজেএম রেজাউল আলম।
সূত্র জানায়, অনিয়ম লুটপাট ভুয়া বিল দুর্নীতির মাধ্যমে এজেএম রেজাউল আলম ঢাকায় তিনটি বাড়ির মালিক হয়েছেন। মাসের বেশির ভাগ সময় তাই ঢাকায়ই থাকেন। বর্তমানে তিনি এক সাথে সুনামগঞ্জের একাধিক উপজেলার মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার পদে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন। ছাতকে গত ৩ বছর ধরে তিনিই সুনামগঞ্জ থেকে এসে এই দায়িত্ব পালন করছেন। তবে মাসে দুই দিনের বেশি সেখানে অফিস করতে পারেন না তিনি। এখানে কেউ আসতে চাইলেও তিনি আসতে দেন না। নানা রকম বাধা তৈরি করেন তিিনি।
তিনি আওয়ালীগের সরকারে আমলে মহিলাবিষয়ক মন্ত্রীর আত্নীয় পরিচয় দিয়ে নানা অনিয়ম দুনীতি ও লুটপাট করে কোটি কোটি টাকার সম্পদে পাহাড় গড়ে তোলেন উপ পরিচালক এজেএম রেজাউল আলম।
সূত্র মতে, একাধিক উপজেলা দায়িত্বে থাকায় জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা এজেএম রেজাউল আলম নিজের ইচ্ছেমাফিক কার্যক্রম চালাতে পারেন। ‘উপজেলা রিসোর্স পুলের মডিউল-১’ বিষয়ক এসবিসিসি প্রশিক্ষণের নামে তিনি পুরো জেলার প্রায় উপজেলায় একইভাবে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রশিক্ষণ বাস্তবে না হলেও তিনি কাগজে-কলমে তা দেখিয়ে বিল উত্তোলন করেছেন। এ জন্য অনেক উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্বাস্থ্য সহকারীদের স্বাক্ষর তাকে জাল করতে হয়। এই স্বাক্ষর তিনি ১০ টাকার রাজস্ব স্টাম্পে দিয়ে এসব টাকা উত্তোলন করেছেন। জেলার ১২টি উপজেলায় মা ও শিশুসহায়তা কর্মসূচির আওতায় ‘উপজেলা রিসোর্স পুলের মডিউল-১’বিষয়ক এসবিসিসি প্রশিক্ষণে সম্মানির অন্তত ২৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাই তার এই অনিয়ম-দুর্নীতি ভুয়া জাল জালিয়াতির কথা স্বীকার করেছেন। এই টাকা তুলতে স্বাক্ষর জাল করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য সহকারীরাসহ ৫৪জন। এমনকি একাধিক স্বাস্থ্য সহকারী পিআরএলে চলে গেলেও তাদের নামেও টাকা তোলা হয়। প্রতিটি প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক,আলোচক তিনি সঞ্চালক এবং একই সাথে আলোচক দেখিয়ে আলাদা সম্মানি ধরে দুটি বিলে টাকা তুলেছেন। এমন অভিযোগ উঠেছে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের সরাসরি সত্যতা স্বীকার করেন। তাদের মাঝে রয়েছেন এমনও ব্যক্তি, যাদের নামে তিনি ভুয়া ভাউচার জমা দিয়ে টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন তিনি।
তারা জানান, যাদের নামে টাকা তোলা হয়েছে তারা কেউই টাকা পাননি। ছাতক উপজেলাসহ ১২টি উপজেলা ৬শত ৪৮জন কর্মকতা কর্মচারিদের দুদিন ব্যাপি এসবিসিসি প্রশিক্ষনে নামে ২০২৪ সালে ৬ ও ৭ নভেম্বর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকতার কাষালয়ে অনুষ্টিত হয়। এ তারিখে ছাতকে কোনো প্রশিক্ষন হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন কর্মকতা কমর্চারিরা। এজেএম রেজাউল আলম একজন ধান্ধবাজ প্রতারনার আশ্রয় নিয়ে ভুয়া বিল জমা দেখিয়ে সব টাকা আত্মসাৎ করেছেন । সরকারি কর্মকর্তা হয়ে অপর সরকারি কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে টাকা আত্মাসাতের ঘটনা জানাজানি হলে সুনামগঞ্জ জেলাজুড়েই অফিস পাড়া ও সংশ্লিষ্ট মহলে রীতিমতো তোলপাড় ও জেলা প্রশাসকের উদ্দ্যোগেই তদন্ত শুরু করেছেন।
সম্প্রতি সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলায় এ রকম প্রশিক্ষণের একটি ভুয়া বিল-ভাউচার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার প্রতিনিধির হাতে এসে পৌঁছে। সেখানে দেখা যায়, গত ৬ এবং ৭ নভেম্বর ২০২৪ হওয়া প্রশিক্ষণ কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম। এতে তার সম্মানি ধরা হয়েছে ৭ হাজার টাকা। প্রশিক্ষক ও আলোচক হিসেবে সুনামগঞ্জের জেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ও ছাতকের চলতি দায়িত্বে থাকা এজেএম রেজাউল আলম ১০ হাজার টাকা, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নুসরাত আরেফিন ৪ হাজার টাকা, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. শহীদুল ইসলাম ৫ হাজার টাকা এবং একই অনুষ্ঠান সঞ্চালনার জন্য এজেএম রেজাউল আলমের নামে আবার ধরা হয়েছে ৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া দুই দিনে মোট ১০৮ জন স্বাস্থ্য সহকারীর নামে সম্মানি তোলা হয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। একটি প্রশিক্ষণ থেকেই তিনি মোট ২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা তুলেছেন। একই অনুষ্ঠানে নিজেই আলোচক হিসেবে একটি এবং সঞ্চালক দেখিয়ে আরেকটি সম্মানি তুলেন তিনি। এভাবে সুনামগঞ্জের প্রায় প্রত্যেকটি উপজেলায় প্রশিক্ষণ দেখিয়ে জাল স্বাক্ষরে টাকা তুলে নেন তিনি। ১২ উপজেলায় এভাবে অন্তত ২৫ লাখেরও বেশি টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন বলে দাবি করেন সুনামগঞ্জ স্বাস্থ্য বিভাগের একাধিক সূত্রের।
সূত্র মতে, এ রকম প্রশিক্ষণে প্রত্যেক আলোচকের ২ হাজার টাকা করে সম্মানি হওয়ার কথা। সেখানে দেখানো হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। এটিও নিয়মের বাইরে রয়েছে। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এজেএম রেজাউল আলম তার বিরুদ্ধে ভূয়া ভাউচার ও জাল স্বাক্ষরে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কৌসলে ঘুড়েই স্বীকার করে বলেন, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রশিক্ষণে উপস্থিত সবাইকে সম্মানি দেওয়া হয়েছে। ওই সময়কার প্রশিক্ষনে অনুষ্টানে কোন ছবি আছে কি না প্রশ্ন করলে তিনি অসুস্থ বলে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে মোবাইল ফোনে জানান, তিনি এখন ঢাকায় আছেন, অসুস্থ। অফিসে এসে সরাসরি দেখা করে কথা বলবেন তিনি।
এব্যাপারে ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নুসরাত আরেফিন জানান, তিনি ছাতকে এসে যোগদানই করেছেন ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ। এর আগে তিনি কীভাবে ছাতকে কর্মশালায় যোগ দেবেন? বলেন, আমি ছিলামই না তখন। অথচ আমার নামে আমার স্বাক্ষর জাল করে সম্মানি বিল তোলা হয়েছে! তিনি জানান, তার কাছে এসব অভিযোগ এসেছে। অনেক স্বাস্থ্যকর্মী জানিয়েছেন, তাদের নামেও সম্মানি বিল করা হয়েছে। কিন্তু তারা কেউই তা পাননি।
এ নিয়ে ছাতক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ রকম কোনো প্রশিক্ষণে অংশ নেননি উল্লেখ করে তার স্বাক্ষর জাল করে টাকা তোলায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এ রকম কোনো প্রশিক্ষণ কর্মশালা হয়নি। তিনি ২৪ সালে ১১ নভেম্বর ছাতকে যোগদান করেন তিনি। একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে অপর সরকারি কর্মকর্তার স্বাক্ষর কীভাবে তিনি জাল করতে পারলেন? তিনি ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন না, এমনকি প্রশিক্ষণের কোনো টাকাও তাকে দেওয়া হয়নি।
এব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাহিনা আক্তার বলেন, প্রত্যেক উপজেলায় এ রকম প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা। কিন্তু সুনামগঞ্জের ছাতকে যে হয়নি তা আমি আগে জানতাম না। এখন শুনছি সেখানে প্রশিক্ষণ না করে টাকা তোলা হয়েছে। এটি হতে পারে না, মারাত্মক অন্যায়। তিনি বলেন, একই অনুষ্ঠানে সঞ্চালক ও প্রশিক্ষক আলাদা সম্মানি নিতেও পারেন না। তা ছাড়া ইউএনও থেকে বেশি সম্মানি পাবেন না জেলা বা উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা। এখানেও তিনি সঠিক করেননি।
বিষয়: #কর্মকর্তার #গায়েবি #ছাতক #পকেটে #প্রশিক্ষণ #সরকারি