মঙ্গলবার ● ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » ছাতক-দোয়ারাবাজার রুট: ভারতীয় গরু- মহিষ চোরাচালানের নিরাপদ করিডোর
ছাতক-দোয়ারাবাজার রুট: ভারতীয় গরু- মহিষ চোরাচালানের নিরাপদ করিডোর
আনোয়ার হোসেন রনি ছাতক প্রতিনিধি::
![]()
সুনামগঞ্জের ছাতক-দোয়ারাবাজার রুট যেন ভারতীয় গরু-মহিষ পরিবহনের নিরাপদ করিডোরে পরিণত হয়েছে। সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা দিয়ে প্রতিরাতেই শত শত গরু-মহিষ প্রবেশ করছে বাংলাদেশে। পরে ইজারাকৃত পশুর হাটের দেওয়া রশিদে পাচ্ছে বৈধতার কাগজপত্র। সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি চোরাচালান সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে অশান্ত হয়ে উঠছে সীমান্ত ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
রশিদে বৈধতা, প্রশাসনের নীরবতা
সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে প্রবেশ করা গরু-মহিষ ইজারাদারদের রশিদের মাধ্যমে বৈধ হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের উদাসীনতার সুযোগে এ রশিদই হয়ে উঠছে পাচারের লাইসেন্স। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক সময় আটকে অনাগ্রহ দেখায়। আর আটক হলেও আদালতে রশিদের দোহাই দিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা ছাড়িয়ে নিচ্ছে মালামাল।
স্থানীয়রা জানান, রশিদের জোরেই প্রতিরাত শতশত ট্রাক ভর্তি ভারতীয় গরু-মহিষ ছাতক-দোয়ারাবাজার রুট হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। এতে সরকারের রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে, আর সিন্ডিকেটের হাতে জমছে কোটি কোটি টাকার কালো অর্থ।
বাড়ছে অপরাধ ও সহিংসতা
ভারতীয় গরু-মহিষকে ঘিরে দুই উপজেলায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। প্রায়ই চোরাকারবারিদের হাতে বিজিবি, পুলিশ ও সাংবাদিকরা হামলার শিকার হচ্ছেন। এমনকি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর গুলিতে চোরাকারবারিদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।সীমান্ত ঘেঁষা এলাকাগুলো এখন ভয় ও আতঙ্কের নাম। দিনে বা সন্ধ্যায় বর্ডার এলাকায় অপরিচিত কেউ প্রবেশ করলে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসাই সৌভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে হামলা বা চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন প্রায়শই।
সাতটি হাট, কোটি টাকার ইজারা
দোয়ারাবাজার উপজেলায় গড়ে উঠেছে সাতটি পশুর হাট—ভোগলা, বাংলাবাজার, লক্ষীপুর, লিয়াকতগঞ্জ, বালিউরা, শ্রীপুর ও নরশিংপুর। এর মধ্যে সীমানা ঘেঁষা বাংলাবাজার, বোগলাবাজার ও নরশিংপুর এখন সোনার হরিণে পরিণত। এসব বাজারের ইজারা মূল্য এক থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত। বাজারে দেশীয় পশুর উপস্থিতি নেই বললেই চলে। মূল ব্যবসা হচ্ছে ভারতীয় গরু-মহিষের রশিদ বিক্রি। সিন্ডিকেটের কয়েকশ সদস্য ক্রেতা-বিক্রেতা সেজে এ ব্যবসা চালাচ্ছেন। বিশেষ করে নরশিংপুর পশুর হাটের রশিদের জোরেই প্রতিরাত শত শত মহিষ দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যাচ্ছে।
সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য
স্থানীয় সূত্র জানায়, নরশিংপুর বিনন্দগর এলাকার আব্দুল আজিজ, বাজার ইজারাদার আব্দুল মতিন, শ্রীপুর গ্রামের আহাদ এবং বালিউড়া এলাকার সালেহ আহমদ—এরা গরু-মহিষ চোরাচালান সিন্ডিকেটের মূল হোতা। শুধু গরু-মহিষ নয়, মাদকসহ নানা চোরাচালান পণ্যও এ পথেই ঢুকছে দেশে। বাজারের আশপাশে গড়ে উঠেছে একাধিক সেড। প্রতিরাতে এসব সেডে গরু-মহিষ রাখলে ব্যবসায়ীদের দিতে হয় ৩০০ টাকা। আর ইজারাদারদের রশিদ পেতে গুনতে হয় ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
সীমান্তজুড়ে কোটি টাকার লেনদেন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী জানান, প্রতিরাতে ৩ থেকে ৪ হাজার গরু-মহিষ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। অথচ দোয়ারাবাজারে গরু-মহিষ উৎপাদনের কোনো খামার নেই। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। চোরাচালান করা এসব গরু-মহিষের মূল অর্থ লেনদেন হয় হুন্ডির মাধ্যমে। বোগলা এলাকার মন্তাজ আলীর ছেলে শারফুল এ লেনদেনের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের দায়িত্বে রয়েছেন তার শ্যালক পলাশ আহমদ। অভিযোগ আছে, এই চোরাচালান ব্যবসা থেকে অর্জিত অর্থে শারফুল সিলেটে একাধিক বাড়ি ও মালদ্বীপে হোটেল নির্মাণ করেছেন।
হঠাৎ কোটিপতি, আবার সর্বশান্ত
চোরাচালান ব্যবসায় কিছু লোক রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে কলাউরা ও জাহাঙ্গীরনগর গ্রামের আনোয়ার ও নতুন আনোয়ারের নাম পাওয়া যায়। কয়েক বছর আগে চা বিক্রি ও মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন তারা কোটি টাকা খরচ করে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন।
তবে সবাই ভাগ্যবান নন। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী শেষ পর্যন্ত সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। মূল সিন্ডিকেটের হাতে পড়ে তাদের পুঁজি হারাতে হচ্ছে। চোরাকারবারি ও প্রভাবশালীদের যোগসাজশ ইতিপূর্বে ৬৭ জন চোরাচালান ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করে সিলেটের দুদকে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগকারীর নিরাপত্তার স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করা হয়নি। স্থানীয়দের দাবি, চোরাকারবারিদের পেছনে মদদ দিচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারা।
এছাড়া প্রতিটি গরু-মহিষের পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামেও টাকা আদায় করে তথাকথিত ‘লাইনম্যান’ নামের ব্যক্তিরা। ফলে কেউ যেন দায় এড়াতে না পারে, এমন এক জটিল যোগসাজশে রূপ নিয়েছে পুরো সিন্ডিকেট।
বিজিবি-পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
সীমান্ত নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিজিবির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছেন, প্রতিদিন ভারত থেকে ১০০-১৫০টি গরু-মহিষ আসে বাংলাদেশে। যদিও অনুসন্ধান বলছে, এ সংখ্যা আসলে কয়েকগুণ বেশি।
এক হিসেবে দেখা যায়, শুধুমাত্র ভারতীয় গরু-মহিষের রশিদ বিক্রি করেই ইজারাদাররা বছরে হাতিয়ে নিচ্ছেন ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকা। গত এক মাসের হিসাবে দেখা যায়, শত শত ট্রাক ভর্তি হয়ে ৫ থেকে ৬ হাজার গরু-মহিষ গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বার্ষিক হিসাবে দাঁড়ায় অর্ধকোটিরও বেশি, যার বাজারমূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা।
তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাজারের রশিদ থাকলে তাদের কিছু করার নেই। ছাতক-দোয়ারাবাজার সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মো. আব্দুল কাদির বলেন, “রশিদ থাকলে পশু বৈধ হয়ে যায়। তবে পুলিশের নামে কেউ টাকা নিলে বা কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রশাসনের অসহায়ত্ব
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অরূপ রতন সিং জানান, হাটের এত কাছাকাছি সেড থাকার কথা নয়। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে। বাজারগুলো সীমান্ত এলাকা থেকে সদর এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। অন্যদিকে বিজিবি ৪৮ ব্যাটালিয়ন সিলেট ও ২৮ ব্যাটালিয়ন সুনামগঞ্জের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বৈধ আমদানির দাবি
স্থানীয় সচেতন মহল মনে করে, ভারতীয় গরু-মহিষ বৈধ পথে আমদানি করা হলে সরকারের রাজস্ব বাড়বে, ব্যবসায়ীরাও উপকৃত হবেন। অপরাধ দমন ও দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে চোরাচালান সিন্ডিকেটের কার্যক্রম বন্ধ করা জরুরি। বর্তমানে সীমান্ত এলাকায় অবাধে গরু-মহিষ আসায় একদিকে যেমন কিছু প্রভাবশালী রাতারাতি কোটিপতি হচ্ছেন, অন্যদিকে সাধারণ ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনগণ চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।##
বিষয়: #করিডোর #গরু #চোরাচালান #ছাতক #দোয়ারাবাজার #নিরাপদ #ভারতীয় #মহিষ #রুট




গ্রেফতার দেখানো হলো সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে
শেখ হাসিনা ও কামালের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে আপিল করল প্রসিকিউশন
নির্বাচন বানচাল ও অভ্যুত্থানকে নস্যাৎ করতেই টার্গেট কিলিং হচ্ছে: নাহিদ
মানবাধীকার অপরাধ মামলা
ওসমান হাদিকে গুলি: সন্দেহভাজন ফয়সালের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ
শিশু সাজিদের মৃত্যুর ঘটনায় ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে লিগ্যাল নোটিশ
‘হাদির সঙ্গে নির্বাচনি প্রচারণায় ছিলেন গুলি করা দুই সন্দেহভাজন’
হাদির হামলাকারীদের ধরিয়ে দিলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
ওসমান হাদির অবস্থা এখনো অত্যন্ত আশঙ্কাজনক: মেডিকেল বোর্ড
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদির ওপর হামলাকারী সন্দেভাজন ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য প্রদানের অনুরোধ
