

রবিবার ● ২৪ আগস্ট ২০২৫
প্রথম পাতা » মতামত » মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির অচেনা যাত্রাপথঃ সর্ষের মধ্যে ভূত
মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির অচেনা যাত্রাপথঃ সর্ষের মধ্যে ভূত
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সিলেটের মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয় একদিন আশার প্রদীপ ছিল। ভৌগোলিক অবস্থান, ছাত্রবান্ধব পরিবেশ, প্রকৃতির সান্নিধ্য–সব মিলিয়ে কেউ কেউ কল্পনায় দেখেছিলেন দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু সময়ের করাল গ্রাসে সেই স্বপ্ন যেন ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে দুঃস্বপ্নে। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেই যেন লুকিয়ে আছে অদৃশ্য এক শত্রু— ঠিক যেন সর্ষের মধ্যে ভূত।
শিক্ষক অপসারণ, ছাত্র বিভ্রান্তি, রাজনৈতিক ছত্রছায়া, আত্মীয় ও স্বজনপ্রীতি, রাষ্ট্রপতি নিয়োগকৃত ভাইস চ্যান্সেলরকে ক্যাম্পাসে প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা—সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি যেন এক অচেনা পথে হাঁটছে। সাম্প্রতিক এক ঘটনায় তো রীতিমতো বিস্ময়ের ঝড় বইয়ে গেছে—একজন ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থীর দেশের দুই প্রখ্যাত শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হত্যার হুমকি, অপ্রীতিকর কার্টুন প্রকাশ। বিশ্বদরবারে মুহূর্তেই প্রশ্নের ঝড় উঠল—বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর আসলে কী ঘটছে?
কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া ছিল আরো রহস্যময়। কেউ বললেন “আমরা এসব সমর্থন করি না”, কিন্তু প্রশ্ন হলো— এ ধরনের বিবৃতি কি শিক্ষার্থীদের সম্মান রক্ষা করে, নাকি উল্টো বিভ্রান্তির জন্ম দেয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের অফিসিয়াল বক্তব্য আবার অন্যদিকে ইঙ্গিত করে—যেন ভিকটিম নয়; বরং অভিযুক্তকেই আড়ালে সমর্থন দেওয়া হচ্ছে।
সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা ঘটল ছাত্র সংগঠনগুলোর অবস্থানে। মেট্রোপলিটনের ছাত্র ইউনিয়ন প্রকাশ্যে অভিযুক্তের পক্ষ নিয়ে দাঁড়াল, ভিকটিম শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই বিবৃতি দিল। তারপর পেইড মিডিয়ার তৎপরতায় খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। ফলাফল? শতাধিক ব্যক্তি অভিযুক্তের পক্ষে দাঁড়ালেন, অথচ প্রকৃত শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াতে দ্বিধা করলেন অনেকে। পরে অবশ্য দেশ-বিদেশের কয়েকশো শিক্ষক একত্র হয়ে প্রতিরোধ গড়লেন, নইলে হয়তো ঘটনাটি ভিন্ন দিকে মোড় নিত।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বিতর্কের আরেক পর্ব শুরু হলো প্রো-ভিসি নিয়োগ নিয়ে। আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে নিয়োগ লাভের অভিযোগে বর্তমান ভিসিকে বাধ্যতামূলকভাবে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, অথচ সরাসরি আওয়ামীলীগ রাজনীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে জর্জরিত বিতর্কিত শিক্ষক ইশরাত ইবনে ইসমাইলকে বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ প্রো-ভিসি বানাল। এ যেন নিজেদের নীতির প্রতিই প্রকাশ্য অবজ্ঞা। যে ব্যক্তি গত কয়েক মাস ধরে তার মূল কর্মস্থল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বৈধ অনুমতি ছাড়াই “একাডেমিক অ্যাফেয়ার্স” নামে একটি আজগুবি পদ বাগিয়ে অফিস চালাচ্ছিলেন, তিনি আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আসনে! এক বিচিত্র নিয়মে চলছে এ প্রতিষ্ঠান।
তার দাপটও নজিরবিহীন—একসাথে তিনজন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা, অভিযোগবিহীন আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করা, এমনকি ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে শিক্ষকদের বহিষ্কার— এসব ঘটনার নজির একমাত্র সিলেটের মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়েই তৈরি হলো। অথচ ট্রাস্টি বোর্ডের নীরবতা সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েই দেয়।
এর পাশাপাশি রয়েছে ব্যক্তিগত দুর্বলতা ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কাহিনি। কানাডায় নৈতিক কারণে স্কলারশিপ হারানো ও পিএইচডি ডিগ্রী ছাড়া দেশে আসা, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতর্কিত অতীত, জামায়াত-বিএনপি ঘনিষ্ঠ মহলের ছত্রছায়ায় টিকে থাকা—সবকিছুই আজ প্রকাশ্য গোপন। অথচ বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ যেন সবকিছু জানতেও না জানার ভান করে চলছে। কারন হিসেবে অনেকেই বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ এর মেম্বারদেরদের সাথে আগের সরকারের গভীর সখ্যতাকেই দ্বায়ী করছে। আর এভাবেই কেবল মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে নয়; বরং আওয়ামীলীগের পুণর্বাসন সারা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে হচ্ছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ স্পষ্ট বলছে— বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারারা নিয়োগের প্রস্তাবনা পাঠাবে। যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের ভেটিং নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন করবেন। এখন প্রশ্ন হলো জুলাই ২০২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে যেখানে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ ও দল হিসেবে আওয়ামীলীগের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ সেখানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের প্রাক্তন কর্মী ও আওয়ামী পন্থী শিক্ষক বিতর্কিত শিক্ষক ইশরাত ইবনে ইসমাইলকে বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ প্রো-ভিসি হিসেবে মনোনয়ন ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনকে পাশ কাটিইয়ে চূড়ান্ত নিয়োগের আয়োজন করলো কোন হীন উদ্দেশ্যে। সিলেট অঞ্চলে কি যোগ্য কোনো শিক্ষক ছিল না? কেন বিপুল অর্থ ব্যয় করে বিতর্কিত একজনকে প্রো-ভিসি বানানো হলো? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-স্টাফরা যখন অস্বাভাবিক স্বল্প বেতনের যন্ত্রণায় ভুগছে, তখনই কেন রাজনৈতিক দোসরদের পকেট ভারী করা হচ্ছে?
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো পরিবারতন্ত্র। প্রতিদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও তার সন্তান বর্তমান চেয়ারম্যান গোয়েন্দা অফিসারের মতো নজরদারি চালান প্রতিষ্টানটির সর্বত্র । আত্মীয়-স্বজন দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছে প্রশাসনের প্রতিটি পদ। যিনি মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবেন, তার জন্য অপেক্ষা করছে অপসারণ। একাডেমিক পরিবেশ দিন দিন সামরিক ছাউনির মতো হয়ে উঠছে। এমতাবস্থায়, শিক্ষার্থীদের মনে তাই ভেসে বেড়াচ্ছে নানান প্রশ্ন— যোগ্য কোনো স্থানীয় শিক্ষক কি সত্যিই ছিল না? বেসরকারী এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কি রাজনৈতিক ঘাঁটিতে পরিণত হচ্ছে? শিক্ষকদের একসাথে বহিষ্কার করার প্রকৃত কারণ কী? বিশ্ববিদ্যালয় কি তবে বোর্ডের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মাত্র?
আজ মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়াল সীমানায়। স্বপ্নের যে প্রতিষ্ঠানটি একদিন আলো ছড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটি আজ আত্মীয়প্রীতি, রাজনৈতিক আনুগত্য আর স্বেচ্ছাচারের বোঝায় ডুবছে।
“সর্ষের মধ্যে ভূত”— এই প্রবাদটি মেট্রোপলিটনের বর্তমান পরিস্থিতির চেয়ে কোথাও এত বেশি প্রযোজ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি সিদ্ধান্তই যেন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা তৌফিক রহমান চৌধুরী ও বর্তমান চেয়ারম্যান তানভীর রহমান চৌধুরী সর্বেসর্বা, তাদের কথা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়েনা-সেখানে জনসাধারণের কাছে ভুল মেসেজ দেয়া হচ্ছে। যদি দ্রুত এর প্রতিকার না হয়, শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের সঠিক জবাব না মেলে—তবে ইতিহাসে মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি হয়ে থাকবে কেবল একটি করুণ ব্যর্থতা, বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষার ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়।
এর শেষ কোথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ষ্টাফ শিক্ষক শিক্ষার্থী কেউই জানেনা। সকলেই রয়েছেন এক অজানা আতঙ্কে । এনিয়ে সমগ্র সিলেট জুড়ে বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা সমালোচনা। এবিষয়ে কথা হয় সিলেটের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে তাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষাবিদ-রাজনীতিক-সাংবাদিক-ব্যবসায়ী-সমাজচিন্তক তাদের সকলেরই অভিমত সিলেটের মানুষ এই প্রতিষ্টানটিকে নিয়ে যেস্বপ্ন দেখে আসছিল তাএখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। পরিবারতন্ত্র ও স্বজনপ্রীতির কারনে প্রতিষ্টানটি আজ ধ্বংশের পথে।
বিষয়: #অচেনা #ইউনিভার্সিটি #মেট্রোপলিটন #যাত্রাপথ

